‘আমার পরিচয়’ কবিতা অবলম্বনে বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় বর্ণনা করুন।

 





প্রশ্ন: ‘আমার পরিচয়’ কবিতা অবলম্বনে বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় বর্ণনা করুন।



'আমার পরিচয়' কবিতাটিতে বাঙালির জাতিসত্তার পরিচয় ফুটে উঠেছে। বাঙালির জাতিসত্তার পরিচয় হিসেবে কবি বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যকে তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন, বাংলা লোক সাহিত্য, বাংলার বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম-বিদ্রোহ, আধুনিক কালজয়ী কাব্য সাহিত্য, হিন্দু ও মুসলিম ঐতিহ্য, বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক এবং স্থাপত্য নিদর্শনের পরিচয়। কবি বাঙালির এই আত্মপরিচয়কে 'আমার' শব্দটি দ্বারা প্রকাশ করেছেন। কবি যেহেতু বাঙালি তাই তিনি তাঁর পরিচয়ের মাধ্যমে সমগ্র বাঙালি জাতির সামগ্রিক পরিচয়কে তুলে।

আমি জন্মেছি বাংলায়, আমি বাংলায় কথা বলি,

আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি।

চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।

তেরোশত নদী শুধায় আমাকে, 'কোথা থেকে তুমি এলে?'

কবি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেন এবং বাংলা ভাষায় কথা বলেন। কবি এখানে বাঙালি জাতির প্রতীক। বাঙালি জাতি হাজার বছর ধরে কোমল পলিমাটিতে তাদের পায়ের চিহ্ন ফেলে আলপথ দিয়ে হেঁটে চলেছে। তেরোশত নদীর এই নদীমাতৃক দেশে নদী কবিকে জিজ্ঞাসা করে কোথায় থেকে কবি অর্থাৎ বাঙালি জাতির উদ্ভব, কী তাদের পরিচয়। তাই তো কবি তার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন-

 

আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে।

আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।

 

নদীর প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে কবি বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় দিয়েছেন। বাঙালি জাতির রয়েছে ঐশ্বর্যময় সাহিত্য-সংস্কৃতির ভাণ্ডার। এর প্রথম নিদর্শন 'চর্যাপদ'। চর্যাপদ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রচীনকালের প্রথম এবং একমাত্র নিদর্শন। পূর্বে বাঙালি জাতি নৌপথে নৌকা, জাহাজের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য করত। কবি আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ঐতিহ্যের পরিচয় দেওয়ার জন্যে মনসামঙ্গল কাব্যের চাঁদ সওদাগরের ডিঙার বহরের কথা উল্লেখ করেছেন।

কবি বলেন বাঙালির ইতিহাস একদিনের ইতিহাস নয়। বাঙালির ইতিহাস বিদ্রোহে পরিপূর্ণ। বাঙালি জাতির বিদ্রোহের ঐতিহ্য বোঝাতে কবি দিব্যকের নেতৃত্বে অনন্ত-সামান্ত-চক্র মিলিত হয়ে মহীপালের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ সংগঠিত হয় সেই কৈবর্ত বিদ্রোহের উল্লেখ করেছেন। পালযুগে চিত্রকলা এবং শিল্প সাহিত্যে অসামান্য বিকাশ সাধিত হয়। কবি আমাদের শিল্পের ঐতিহ্য বোঝাতে পালযুগের চিত্রকলার উল্লেখ করেছেন।

 

আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে।

আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।

প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বাঙলার জনপদে নানা সম্প্রদায়ের বসবাস। আমাদের এদেশে একসময় অনেক বৌদ্ধরা বসবাস করত। তাদের স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ এখনো বাংলায় বিদ্যমান। এছাড়াও কবি আমাদের এই প্রত্নতাত্ত্বিক আমাদের পরিচয় দেওয়ার জন্যে পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহারের উল্লেখ করেন। ভারতবর্ষ হিন্দু প্রধান রাষ্ট্র। বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের একটি অংশ। এজন্য কবি হিন্দু সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে মন্দির-বেদির কথা উল্লেখ করেন।

 

এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে।

এসেছি বাঙালি জোড়াবাংলার মন্দির-বেদি থেকে।

কবি আমাদের মুসলিম ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে সোনা মসজিদের কথা উল্লেখ করেছেন। চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলায় অবস্থিত অসাধরণ শিল্পসৌন্দর্য মণ্ডিত স্থাপত্য কর্ম হিসেবে সোনা মসজিদ অন্যতম। বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমানের মিশ্র ঐতিহ্যের সহাবস্থান বুঝাতে কবি আউল-বাউল মাটির দেউল কথাটি রচনা করেছেন। এদেশে ধর্ম প্রচারের জন্য সুফি-সাধক বা আউলিয়াদের আগমন ঘটেছে। বাউল গান বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জনপ্রিয়।

এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে।

এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।

একসময় বাংলায় পাঠান কররাণী বংশের রাজত্ব দুর্বল হয়ে পড়লে বারোভূঁইয়াদের উত্থান ঘটে। তাঁরা একত্রিত হয়ে মোঘল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে লড়াই করে। সংঘবদ্ধ হয়ে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার যে চেষ্টা সেই ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে কবি বারোভূঁইয়াদের অনুষঙ্গ ব্যবহার করেন। অন্যদিকে বাংলা লোকসাহিত্যের ভাণ্ডার যে সমৃদ্ধ তার পরিচয় দেওয়ার জন্যে কবি 'কমলার দীঘি' এবং মহুয়া পালা'র কথা উল্লেখ করেছেন।

আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারো ভূঁইয়ার থেকে।

আমি তো এসেছি 'কমলার দীঘি', 'মহুয়ার পালা' থেকে।

ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালিরা বিভিন্ন সময় আন্দোলন-সংগ্রাম করে। সেই আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহ্যকে তুলে ধরার জন্যে কবি তিতুমীরের কথা উল্লেখ করেছেন। তিতুমীর ১৮৩১ সালে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে শহিদ হন। গীতাঞ্জলি এবং অগ্নিবীণা যথাক্রমে রবীন্দ্রনাথ এবং কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যের ঐশ্বর্যময় ভাণ্ডারকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যেই কবি এই দুটি কাব্যগ্রন্থের উল্লেখ করেন। গীতাঞ্জলির জন্য ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এশীয়দের মধ্যে সর্বপ্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে।

আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।

ক্ষুদিরাম এবং সূর্যসেন উভয়ই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকারী, ক্ষুদিরাম (১৮৮৯-১৯০৮) অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়ে ভুলবশত দুইজন ইংরেজ মহিলাকে হত্যা করেন। এই অপরাধে ১৯০৮ সালে মহান বিপ্লবী ক্ষুদিরামের ফাঁসি কার্যকর হয়। মাস্টারদা সূর্যসেন ১৯৩০ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে চট্টগ্রামকে মুক্ত করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাকেও ১৯৩৪ সালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। বিভিন্ন আন্দোলনে বাঙালিরা যে আত্মত্যাগ করেছে ক্ষুদিরাম এবং সূর্যসেনের উল্লেখ তারই পরিচয় বহন করে।

এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্য সেনের থেকে।

বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির পটভূমিতে বিপুল 'শিল্পকর্ম' রচনা করে জয়নুল আবেদিন (১৯১৪-১৯৭৬) এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১- ১৯৫১) বিখ্যাত হয়ে আছেন। জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশে শিল্পকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ। অন্যদিকে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। কবি চিত্রশিল্পে বাংলাদেশের অবদানকে তুলে ধরতে জয়নুল আবেদিন এবং অবনঠাকুরের কথা উল্লেখ করেছেন।

এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।

১৯৫২ সালে বাঙালিরা রাষ্ট্রভাষার জন্যে আন্দোলন করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এর মূল্য হিসেবে তাদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত 'জয়বাংলা' ধ্বনি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করতে অনুপ্রেরণা যোগায় এবং সেই অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি জাতি তাদের স্বাধীনতা অর্জন করে।

এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে।

এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।

আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে।

আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন