শাস্তি গল্পের সার সংক্ষেপ।। শাস্তি গল্পের সারাংশ

 





'শাস্তি' রবীন্দ্রনাথের অন্যতম প্রধান গল্প, তাতে সন্দেহ নেই। শিল্পের বিচারে এ গল্প উঁচু দরের। আশ্চর্যের কথা, এ গল্প সমকালে যোগ্য অভ্যর্থনা পায় নি। শ্রাবণ ১৩০০ বঙ্গাব্দের সাধনায় প্রকাশিত এই গল্প পড়ে 'সাহিত্য'-সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি বুঝতে পারেন নি।


গল্পটি চারটি পরিচ্ছেদে বিভাজিত। অতিকথনবজিত, অনিবার্য দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং নিষ্ঠুর পরিণামের মুখে একাগ্রলক্ষ্য একটি করুণ নিষ্ঠুর গল্প। এ গল্প বারবার পড়লে এর বিন্যাসকৌশল প্রতিভাত হয়। স্বামী ছিদাম রুই ও তার ভালোবাসা সম্পর্কে চন্দরার মোহমুক্তি, স্বামীর বিশ্বাসভঙ্গে তার প্রবল অভিমান এবং সেই অভিমানবশে ফাঁসিকাঠের দিকে তার যাত্রা: সমস্ত ব্যাপারটা অমোঘ কার্যকারিতায় পরিণামের দিকে ধাবিত। বর্ষণ- ক্ষান্ত সন্ধ্যার আকাশ ও নিকটবর্তী রাক্ষুসী পদ্মা এই ক্রুরকাণ্ডের উপযুক্ত পটভূমি হয়ে দেখা দিয়েছে। সায়াহ্নের গুমোট যেকোনো মুহূর্তে ঝড় হয়ে ভেঙে পড়তে পারে। কইদের সংসাবে তা ঘটেছে।

পুইমাঁচা গল্পের সমালোচনা প্রথম পর্ব দেখুন

ক্ষুধার্ত দুখিরামের স্ত্রী রাধা স্ফুলিঙ্গের অপেক্ষায় বারুদের স্তূপ হয়েছিল। দুখিরামের কথায় ও ব্যবহারে তাতে আগুন জ্বলে উঠেছে এবং ক্ষুধিত ক্রুদ্ধ দুখিরাম লাফিয়ে উঠে স্ত্রীর মাথায় হাতের দা'য়ের এক কোপ বসিয়ে দিয়েছে-সঙ্গে সঙ্গেই রাধার মৃত্যু ঘটেছে। ছোট ভাই ছিদাম বড় ভাইকে বাঁচাবার আর কোনো পথ না পেয়ে বলে ফেলেছে, তারই স্ত্রী চন্দরা বড় জা-কে খুন করেছে। সমস্তটাই ভ্রান্তি, হতবুদ্ধি, অবিবেচনা ও মূর্খতার ফল। কিন্তু সেই ফল ভোগ করতে হলো অষ্টাদশী কৌতুকপ্রিয় কৌতূহলপ্রিয় চঞ্চলা চন্দরাকে। 


এই চন্দরাকে লেখক বড়ো যত্ন করে গড়ে তুলেছেন, কিন্তু তাকে রক্ষা করতে পারেন নি। চন্দরার রূপবর্ণনা ও স্বামীর অন্যায় অপরাধে চন্দরার প্রতিক্রিয়া ও পরবর্তী ঘটনা তার প্রমাণ।


"চন্দরার বয়স সতেরো-আঠারোর অধিক হইবে না। মুখখানি হৃষ্টপুষ্ট গোলগাল; শরীরটি অনতিদীর্ঘ, আঁটসাঁট, সুস্থসবল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে এমন একটি সৌষ্ঠব আছে যে চলিতে-ফিরিতে নড়িতে-চড়িতে দেহের কোথাও যেন কিছু বাধে না। একখানি নূতন- তৈরি নৌকার মতো; বেশ ছোটো এবং সুডোল, অত্যন্ত সহজে সরে এবং তাহার কোনো গ্রন্থি শিথিল হইয়া যায় নাই। পৃথিবীর সকল বিষয়েই তাহার একটা কৌতুক এবং কৌতূহল আছে, পাড়ায় গল্প করিতে যাইতে ভালোবাসে, এবং কুম্ভ কক্ষে ঘাটে যাইতে-আসিতে দুই অঙ্গুলি দিয়া ঘোমটা ঈষৎ ফাঁক করিয়া উজ্জ্বল চঞ্চল ঘনকৃষ্ণ চোখ দুটি দিয়া পথের মধ্যে দর্শনযোগ্য যাহা-কিছু সমস্ত দেখিয়া লয়।"

পুইমাঁচা গল্পের সমালোচনা দ্বিতীয় পর্ব দেখুন


এই যুবতীকে তার স্বামী পরের অপরাধ তার কাঁধে নেবার জন্য অনুরোধ করল। "সে তো একেবারে বজ্রাহত হইয়া গেল। ছিদাম তাকে আশ্বাস দিয়া কহিল, 'যাহা বলিতেছি তাই কর, তোর কোন ভয় নাই, আমরা তোকে বাঁচাইয়া দিব'।” হায়, কে কাকে বাঁচায়! এমন নয় যে স্বামী-স্ত্রীতে ভাব ছিল না।- “ছিদাম তাহার যুবতী স্ত্রীকে একটু বিশেষ ভালোবাসিত। উভয়ে ঝগড়াও হইত, ভাবও হইত, কেহ কাহাকেও পরাস্ত করিতে পারিত না।... তাহার এই চঞ্চলা যুবতী স্ত্রীর প্রতি সদাশঙ্কিত ভালোবাসা উগ্র একটা বেদনার মতো বিষম টনটনে হইয়া উঠিত।” স্বামীর এই অন্যায় অনুরোধে চন্দরার প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়-বিস্ময়, ক্রোধ, অভিমান।


“চন্দরাকে যখন তাহার স্বামী খুন স্বীকার করিয়া লইতে কহিল, সে স্তম্ভিত হইয়া চাহিয়া রহিল; তাহার কালো দুটি চক্ষু কালো অগ্নির ন্যায় নীরবে তার স্বামীকে দগ্ধ করিতে লাগিল। তাহার সমস্ত শরীর মন যেন ক্রমেই সঙ্কুচিত হইয়া স্বামীরাক্ষসের হাত হইতে বাহির হইয়া আসিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। তাহার সমস্ত অন্তরাত্মা একাত্মা বিমুখ হইয়া দাঁড়াইল।...স. কিছুই শুনিল না, কাঠের মূর্তি হইয়া বসিয়া রহিল।” স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতায় তার, আহত বিস্ময় চন্দরাকে জীবনবিমুখ করে তুলল। আদতে যে জীবনানুরাগী সে প্রবল অভিমানে হয়ে গেল জীবনবিমুখ। তাই পুলিশের কাছে প্রথম এজাহারে ও আদালতে হাকিমের কাছে শেষ এজাহারে সে একই কথা বলেছে-বিনা প্ররোচনায় সে বড়জাকে খুন করেছে। স্বামী ও ভাসুরের স্বীকৃতিতেও কিছু হল না, তার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেল।

পুইমাঁচা গল্পের নামকরণ ক্লিক করুন

গল্পের শেষটি অনবদ্য। বিনা ব্যাখ্যায় চন্দরার প্রবল অভিমান প্রকাশ পেয়েছে। ফাঁসির পূর্বে সিভিল সার্জন যখন শুধিয়েছিলেন, "তোমার স্বামী তোমাকে দেখিতে চায়, তাহাকে কি ডাকিয়া আনিব'। চন্দরা কহিল- 'মরণ'।" অভিমান প্রকাশের এর চেয়ে অমোঘ উপায় আমার জানা নেই। বিদেশী গল্পে একেই বলে চাবুক-মারা সমাপ্তি (Whip Crack ending)। এ ধরনের সমাপ্তি আছে 'মণিহারা', 'জীবিত ও মৃত', 'তপস্বিনী' গল্পে। 


রবীন্দ্রনাথ 'শাস্তি' গল্পে আর একটি বিষয়কে বড় করেছেন, যেমন করেছিলেন 'পোষ্টমাষ্টার'এ। বৃহৎ বিপুল উদাসীন পৃথিবীর কাছে মানুষের সুখদুঃখ কান্না হাসি তুচ্ছ; মানুষ পৃথিবীর সন্তান, কিন্তু বৃহৎ জীবনলীলায় ব্যক্তিমানুষের দাম অকিঞ্চিৎকর। রবীন্দ্রনাথ বারেবারেই এই তত্ত্বকে তাঁর গল্পে তুলে ধরেছেন।


যে মুহূর্তে দুখিরাম তাঁর স্ত্রীর মাথায় দায়ের কোপ বসিয়ে দিল ও মুহূর্তের মধ্যে রাধার মৃত্যু হল, তখন-


"বাহিরে পরিপূর্ণ শান্তি! রাখালবালক গোরু লইয়া গ্রামে ফিরিয়া আসিতেছে। পরপারের চরে যাহারা নূতনপক্ক ধান কাটিতে গিয়াছিল তাহারা পাঁচ-সাতজনে এক- একটি ছোটো নৌকায় এপারে ফিরিয়া পরিশ্রমের পুরস্কার দুই-চারি আঁটি ধান মাথায় লইয়া প্রায় সকলেই নিজ নিজ ঘরে আসিয়া পৌঁছিয়াছে।”


"ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট (চন্দরাকে) সেশনে চালান দিলেন। ইতিমধ্যে চাষবাস হাটবাজার হাসি-কান্না পৃথিবীর সমস্ত কাজ চলিতে লাগিল। এবং পূর্ব পূর্ব বৎসরের মতো নবীন ধান্যক্ষেত্রে শ্রাবণের অবিরল বৃষ্টিধারা বর্ষিত হইতে লাগিল।”

বিলাসী গল্পের সার সংক্ষেপ এখানে


স্বামীর প্রতি চন্দরা নিদারুণ অভিমান নিয়ে প্রাণপণে ফাঁসিকাঠের দিকে ঝুঁকেছে। তার দুঃখে বেদনায় অভিমানে এই বৃহৎ বিপুল পৃথিবীর কিছু আসে যায় না, গল্পলেখক এই ভাবনার পটভূমে নিষ্ঠুর গল্পটিকে সাজিয়েছেন। চন্দরাকে তিনি বড় যত্ন করে গড়ে তুলেছেন, কিন্তু তাকে রক্ষা করতে হাত বাড়িয়ে দেন নি। উদাসীন পৃথিবীর মতোই চন্দরার সৃষ্টিকর্তাও উদাসীন ও নির্মম।



সমালোচনাটি সংগ্রহ করা হয়েছে : কালের পুত্তলিকা; বাংলা ছোটোগল্পের একশ’ বিশ বছর/১৮৯১-২০১০।  পৃষ্ঠা নং- ৩৬-৩৮; দেজ পাবলিশার্স, কলকাতা। প্রথম প্রকাশ: আগস্ট ১৯৮২, চতুর্থ সংস্করণ -২০১১। ISBN - 978-81-295-1292-5



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন