আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল গ্রন্থের মুক্তিযুদ্ধ- বিষয়ক একটি গল্প হলো 'রেইনকোট'। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত গল্পটির বিষয়বস্তু হলো মুক্তিযোদ্ধা মিন্টুর রেইনকোট। গল্পটি প্রসঙ্গে সমালোচক চঞ্চল কুমার বোসের অভিমত-
রেইনকোট গল্পে একটি রেইনকোটের প্রতীকে মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনার উজ্জীবন ঘটানো হয়েছে। এ গল্পে রসায়নের অধ্যাপক নূরুল হুদা পাকিস্তানি মিলিটারিদের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হলেও তার যুবক শ্যালক মিন্টু যুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেয়। মিন্টুর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ নূরুল হুদার জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠলেও তার রেখে যাওয়া রেইনকোট একসময় নূরুল হুদাকে উদ্বুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়।
যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত থাকত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভয়ে। তারা সর্বদা শঙ্কায় থাকত এই ভয়ে যে, কখন যেন পাকিস্তানি বাহিনী এসে দরজায় কড়া নাড়ে আর ধ্বংস করে দেয় সব সুখ-শান্তি। গল্পটিতে একজন ভীতু বাঙালি হিসেবে পাওয়া যায় লেকচারার নূরুল হুদাকে। নূরুল হুদা নানা অত্যাচার সহ্য করেও প্রকাশ করেনি মুক্তিযোদ্ধাদের ঠিকানা-
“মনে হচ্ছে যেন বৃষ্টি পড়ছে মিন্টুর রেইনকোটের ওপর। রেইনকোটটা এরা খুলে ফেলেছে, কোথায় রাখল কে জানে। কিন্তু তার ওম তার শরীরে এখনো লেগেই রয়েছে। বৃষ্টির মতো চাবুকের বাড়ি পড়ে তার রেইনকোটের মতো চামড়ায় আর সে অবিরাম বলে চলে মিসক্রিয়েন্টদের ঠিকানা তার জানা আছে। শুধু তার শালার নয়।” (রেইনকোট)'
বিলাসী গল্পের সার সংক্ষেপ দেখুন
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের অনেক মানুষ যোগ দেয় শান্তিবাহিনীতে। তারা গোপনে এবং প্রকাশ্যে সহযোগিতা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে। কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর 'রেইনকোট' গল্পে কলেজের প্রিন্সিপাল আব্দুস সাত্তার মৃধা এবং পিয়ন ইসাক মিয়ার মধ্য দিয়ে শান্তিবাহিনীর আসল চিত্র রূপায়ণ করেছেন। রেইনকোটের বিবরণ দিতে গিয়ে গল্পকার তুলে এনেছেন মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রসঙ্গ। তখনকার দিনে পাকিস্তানি বাহিনী কীভাবে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ সব প্রকার অধর্মীয় এবং অসামাজিক কার্যকলাপ করেছে, তার বিবরণ পাওয়া যায় গল্পটিতে-
“হয়তো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি প্ল্যাটুন গ্রাম জ্বালিয়ে শ-দুয়েক মানুষ মেরে লাশগুলোকে ফেলে জিপে করে নিয়ে যাচ্ছে জ্যান্ত জোয়ান মেয়েদের, মিন্টুর স্টেনগান নিশ্চয়ই তাক করা রয়েছে ওই মিলিটারিগুলোর দিকে। মিলিটারির সব কটাকে খতম করে মেয়েগুলোকে বাঁচাতে পারব তো? পারবে না?” (রেইনকোট)
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দেশের সর্বত্র মুক্তিবাহিনীর সন্ধানে তল্লাশি চালিয়েছে। তারা বসতভিটা, ঘরবাড়ি, যানবাহন, রাস্তাঘাটসহ সর্বত্র মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সন্ধান করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ধরতে পারলে অমানুষিক অত্যাচার করে তাদের সঙ্গীদের ঠিকানা বের করে আনত। তাদের না পেলে নিরীহ মানুষদের ধরে নিয়ে যেত। স্টেশনে স্টেশনে যানবাহনে তল্লাশি চালিয়ে পুরুষ এবং নারীদের তুলে নিয়ে যেত ক্যাম্পে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এ বিষয়টি তুলে এনেছেন তাঁর গল্পে-
মিলিটারিরা এখন যাবতীয় গাড়ি থামাচ্ছে। গাড়ির প্যাসেঞ্জারদের নামিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয় রাস্তার ধারে। আরেক দল মিলিটারি স্টেনগান তাক করিয়ে রেখেছে এই মানুষের সারির উপর। অন্য একটি দল ফের ওইসব লোকের জামাকাপড় ও শরীরে গোপন জায়গাগুলো তল্লাশি করে। মিলিটারি যাদের পছন্দ করছে তাদের ঠেলে দিচ্ছে পেছনে একটি লরির দিকে। (রেইনকোট)
উপরের বিশ্লেষণ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর ছোটগল্পে যুদ্ধকালীন বাস্তবতা তুলে এনেছেন। তিনি লক্ষ করেছেন, শহরে এবং গ্রামে সর্বত্রই অগ্নিসংযোগ করেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। কোথাও কোনো নিরাপত্তা নেই। তারা পাখির মতো মানুষ হত্যা করেছে। দেশের অভ্যন্তরে তাদের সহযোগিতা করেছে রাজাকার-আলবদররা। অত্যাচার- নির্যাতনে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষও তখন হয়ে উঠেছিল সাহসী। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর প্রতিভার শক্তিমত্তায় মুক্তিযুদ্ধের সময়কার এসব ভয়াবহ চিত্র তুলে এনেছেন তাঁর গল্পগুলোতে।
মাসি পিসি গল্পের বিষয়বস্তু এখানে
সমালোচনাটি সংগ্রহ করা হয়েছে- বাংলাদেশের ছোটোগল্পে মুক্তিযুদ্ধ; লেখক- সোহেল রানা; আগামী প্রকাশনা, প্রথম প্রকাশ ২০২১, ফেব্রুয়ারি। পৃষ্ঠা- ৬৮-৭০; ISBN NO- 978 984 04 2575 4