গল্পটির কেন্দ্রীয় লক্ষ্য এবং লেখকের বিশেষ প্রকৃতি-মনস্কতার সঙ্গেও এর সম্পর্ক-সূত্রটি কঠিন বন্ধনে ব্যঞ্জনাময়। সমগ্র গল্পটির প্রেক্ষিতে শান্ত সরল ঘন প্রকৃতি-পরিবেশ থাকার কারণে, এবং তা গল্পের রসকেন্দ্রে অন্য ব্যঞ্জনা দেওয়ার জন্যই লেখকের প্রকৃতি-ভাবনা পুঁইমাচা নামের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। এমন নাম যেন লেখক-ব্যক্তিত্বের বিভা! অন্য কোনো নামেই এই গল্পটিকে চিহ্নিত করা যেত না।
গল্পের একেবারে প্রথম দিকেই কাহিনী-বর্ণনার সূত্রে ক্ষেন্তির হাতেই দেখি পুঁইগাছ, যে পুঁইগাছ গল্পের শেষে ক্ষেন্তির জীবন-মৃত্যুর পাশাপাশি হয়েছে এক প্রতীকী অস্তিত্ব লেখকের বর্ণনায়:
'তাহার হাতে এক বোঝা পুঁইশাক, ডাঁটাগুলি মোটা ও হন্দে, হল্ চেহারা দেখিয়া মনে হয় কাহার পাকা পুঁইগাছ উপড়াইয়া ফেলিয়া উঠানের জঙ্গল তুলিয়া দিতেছিল। মেয়েটি তাহাদের উঠানের জঞ্জাল প্রাণপণে তুলিয়া আনিয়াছে।'
এই বর্ণনার পাশেই আছে ক্ষেন্তির পার্শ্ববর্তিনী ছোট বোনের হাতের 'দুই-তিন পাকা পুঁইপাতা জড়ানো কোনো দ্রব্য।' ক্ষেন্তি বাবার কাছে 'পাতা জড়ানো দ্রব্যটি মেলিয়া ধরিয়া বলিল চিংড়ি মাছ, বাবা।' ক্ষেন্তির পরবর্তী সংলাপে বোঝা যায়, মাছউলি গয়া- বুড়ি ওর বাবার কাছে দু'পয়সা বাকি থাকায় ওই চিংড়িমাছগুলি দিতে চায়নি, পরে ক্ষেন্তির কথায় দিয়েছে, 'আর এই পুঁইগাছগুলো ঘাটের ধারে রায়কাকা বললে, নিয়ে যা- কেমন মোটা মোটা...'
পুই মাঁচা গল্পের সমালোচনা পর্ব দুই এখানে
এই খণ্ডচিত্র ও সংলাপে আমরা সেকালের দরিদ্র-মলিন গ্রামবাংলার রূপ যেমন প্রত্যক্ষ করি, তেমনি এই গল্পে তার চিত্রের পাশাপাশি গল্পটির নামের উপযোগী বিষয়-বিন্যাসটিকে বুঝতে পারি। গ্রাম্য বাঙালির পক্ষে পুঁইশাক যেমন একান্ত উপাদেয় ও সহজলভ্য খাদ্য, তেমনি তার মধ্যে চিংড়ির স্বাদ-যোগের স্বতঃস্ফূর্ত স্বভাবে স্বাদু রন্ধন-প্রয়াস সহজেই ভোজন- বাসনা তীব্র করে। ক্ষেন্তির এই তৎপরতা, মায়ের কাছ থেকে তার জন্য অসম্ভব ভর্ৎসনা প্রাপ্তি ও চাপা অভিমানে অশ্রুসজল হওয়ায় সেই পুঁইশাকের পাতা কুড়িয়ে-বাড়িয়ে এনে চুপি চুপি পুঁইগাছের 'তরকারি বানানো', খাওয়ার সময় পরম লোভের টানে তা নিঃশেষ করে খাওয়া-এমন সব স্পর্শকাতর অভিমান-রঞ্জিত, খুবই ছোট ছোট মান-অভিমানের পারিবারিক চিত্র 'পুঁইমাচা' গল্পে প্রধান হয়ে উঠতে থাকে। গ্রাম-মানুষের অসহায় দারিদ্র্যের মধ্যে এই জীবনধারণ-পদ্ধতি যেমন অসামান্য বাস্তবতায় আঁকা, তেমনি গল্পের অঙ্গে এদের অবস্থান মূল্যবান প্রত্যঙ্গের গুরুত্ব আনে। গল্পের পরবর্তী অংশে আছে অকালে ক্ষেন্তির শীর্ণকায় পুঁইগাছের চারা লাগিয়ে তাকে বড় করে তোলার, বাঁচিয়ে রাখার আন্তরিক তৎপরতা। ক্ষেন্তির লোভের সঙ্গে, খাদ্যপ্রীতির সঙ্গে, রসনার সঙ্গে, এইসব খেয়াল ও খেলা গল্পের শেষে অজ্ঞাতে তার নিয়তির লীলার প্রতিরূপ আর এক সত্যকে তুলে ধরে। তাই 'পুঁইমাচা' নাম গল্পের কাহিনী ও বিষয়ের ব্যাখ্যায় সার্থক।
গল্পটির নাম 'পুঁইশাক' বা 'পুঁইচারা'-ও লেখক রাখতে পারতেন, বিষয়ের সঙ্গে এতটুকু অসঙ্গত হত না। কিন্তু লেখক তা না করে রেখেছেন 'পুঁইমাচা'। 'মাচা' অর্থে 'মঞ্চ'। আর ছোট ছোট কঞ্চি বা চেরা বাঁশের টুকরো দিয়ে মঞ্চ না করে দিলে পুঁইচারার বৃদ্ধি ঘটে না। মাটিতে বেড়ে ওঠায় তার গৌরবহীনতা, মাচার অধিষ্ঠানে তার গৌরব প্রতিষ্ঠা। গল্পে মাচাতেই পুইগাছটি অফুরন্ত প্রাণস্বভাবে 'মাচা হইতে বাহির হইয়া দুলিতেছে-সুপুষ্ট, নধর, প্রবর্ধমান জীবনের লাবণ্যে ভরপুর।' অথচ তাকে যে এত বড় হওয়ার সুযোগ করে দেয়, সেই ক্ষেন্তি পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্য অন্তর্হিত। ক্ষেন্তি ও পুঁইগাছের স্বভাবে যে বৈপরীত্য, তা অসাধারণ শিল্পের ব্যঞ্জনা পেয়েছে পুঁইগাছের এমন বাড়-বাড়ন্ত স্বভাব হয়ে ওঠার জন্যই। পুঁইমাচায় পুঁইগাছের এই বিবৃদ্ধির চিত্র গল্পের নামের গভীরতর ব্যঞ্জনা আনে। নাম নিশ্চয়ই শিল্প-তাৎপর্যে গভীর অর্থবহ।
শাস্তি গল্পের সার সংক্ষেপ দেখুন
আর একটি ব্যাখ্যা 'পুঁইমাচা' নামের মধ্যে মেলে। তা লেখক-ব্যক্তিত্বের স্বরূপে চিহ্নিত শিল্প-সত্য। বিভূতিভূষণের কাছে প্রকৃতি তাঁর আত্মার আত্মীয়। এই প্রকৃতিকে এ গল্পে পুঁইগাছের প্রতীকে ঘনপিনদ্ধ করেছেন। লেখক প্রকৃতির মধ্যে গভীর রহস্যের সন্ধান করেছেন নানাভাবে। এখানে সেই সন্ধান এক রোমান্টিক অভীপ্সায় পুঁইগাছের প্রতীকে অপরূপত্বে স্থির হয়েছে। সেই নায়িকার জীবন ও পুঁই-এর জীবনের বৈপরীত্যের মূলেই প্রকৃতি-ভাবনার সূত্রে লেখক-ব্যক্তিত্বের ব্যঞ্জনা। মানুষের জীবন তো প্রকৃতির সমস্ত উপকরণ ও স্বভাব দিয়েই গড়া, মৃত্যুতে তার প্রকৃতিতেই বিলীন হওয়া! যে অস্তিত্ব প্রকৃতিরই, তার সীমা আছে, প্রকৃতি কিন্তু অসীম! মানুষ মায়া, মমতা, প্রেম, সুখ, দুঃখ, লোভ-স্বার্থ-এসব দিয়ে প্রকৃতি-প্রদত্ত জীবনকে নিজের মতো করে রাখে, প্রকৃতি তাকে ভাঙে, তার সব কিছু গ্রাস করে মৃত্যু দিয়ে। প্রকৃতির আপন প্রাণ-বেগ, শক্তি, স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ মানুষকে তুচ্ছ করে দেয়। ক্ষেন্তির সামগ্রিক জীবন ও মৃত্যু প্রকৃতিরই খেলা। এই খেলা নির্মম নিরাসক্ত। তা না হলে ক্ষেন্তির চলে যাওয়ার পরেও কোন রহস্যে তারই শিশুকালে লালন করা বড় আদরের পুঁইগাছটি 'সুপুষ্ট, নধর, প্রবর্ধমান জীবনের লাবণ্যে ভরপুর' হয়ে ওঠার বৈশিষ্ট্য পায়! প্রকৃতির রহস্য-সন্ধানী লেখক মাচায় বেড়ে ওঠা পুঁইগাছকে প্রতীক করে নিজের বিশেষ দৃষ্টিকে গল্পের কেন্দ্রীয় লক্ষ্যে pointing finger করেছেন। লেখক-ব্যক্তিত্বের অসাধারণ গুরুত্বে এমন নামের স্থায়ী ব্যঞ্জনা।
সমালোচনাটি সংগ্রহ করা হয়েছে: বাংলা ছোটোগল্প প্রসঙ্গ ও প্রকরণ: বীরেন্দ্র দত্ত, পৃষ্ঠা নং ৩১৫- ৩১৭, পুস্তক বিপণি পাবলিকেশন, কলকাতা। প্রথম প্রকাশ- আগস্ট ১৯৮৫,