কালো মাফলার গল্পের বিষয়বস্তু।। মাহমুদুল হক

 




‘কালো মাফলার’ মাহমুদুল হকের লেখা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটি উল্লেখযোগ্য গল্প। গল্পটির প্রেক্ষাপট হলো যুদ্ধাকালীন এক গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার জীবনচিত্র। যে তার পরিবার পরিজন থেকে আলাদা হয়ে যায় ‍মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য। ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এবং সহযোদ্ধাদের খবর নিতে এসে রাতের রাতের অন্ধকারে সে রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য পালিয়েছিল। কিন্তু চোর সন্দেহে এলাকাবাসীর পিটুনিতে মারা যায়। তার মুক্তিযুদ্ধে চেতনা প্রবাহিত হয় তার বড়ভাই মনোয়ারের মধ্যে। 


‘মনোয়ারের কানে এসব কিছুই ঢোকে না; যে জানে, মাঝরাত থেকে সেও টুলটুলের মতো জড়িয়ে পড়েছে, তখন তার অনেক কাজ।’ (কালো মাফলার)


গল্পটিতে টুলটুল এবং তার ভাই মনোয়ারের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চিত্র, যোদ্ধাদের জীবনাচার, মুক্তিবাহিনীর কর্তব্য, পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের যুদ্ধকালীন ভূমিকা এবং ২৫ মার্চ পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশের অবস্থা। সারাদেশে দিন-রাত কারফিউ জারি ছিল। গুলি, বোমা আর বেয়নেটের খোঁচায় বিপন্ন হয় মানুষের জীবন। লেখকের ভাষায়-


এখন রাত মানে ভারী ভারী বুটের শব্দ, রাত মানে সুমসাম গ্রেফতার, অতর্কিত বেয়নেট চার্জ। আতঙ্কিত ভূতগ্রস্ত অসংখ্য মানুষের মতো প্রাণভয়ে ভীত মনোয়ার আপন মনে রাতভর হাঁই-হাঁই কোদার চালায়। (কালো মাফলার)

শাস্তি গল্পের সমালোচনা দেখুন এখানে


পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে অগ্নিসংযোগ, গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাট চালিয়ে দেশটাকে পরিণত করেছিল শ্মশান-ভূমিতে। একজন মুক্তিযোদ্ধার গোপনে তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে আসার চিত্র তুলে ধরার মাধ্যমে গল্পকার বিষয়টিকে তুলে এনেছেন। এতে দেখা যায়, পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালিদের বাড়ি-ঘর, বাজার, গ্রাম, নগর, বস্তিসহ সবকিছু ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে-


দেশ না শ্মশান। চতুর্দিকে ধ্বংসস্তূপ আর ধ্বংসস্তূপ। যেকোনো সংসার, যেকোনো বাগান ছত্রখান করে দিতে পারে সৈন্যরা। ছারখার করে দিতে পারে লোকালয়। বস্তির পর বস্তি পুড়ছে। এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় হুটোহুটি খেলছে লকলকে আগুন। মুক্তিবাহিনী এক পা এগোয় দু'পা পিছায়, (কালো মাফলার)"



পাকিস্তানি বাহিনী দেশজুড়ে চালিয়েছিল ভয়াবহ গণহত্যা। যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই গুলি করে হত্যা করেছে। এ গল্পে দেখা যায়, রাজাকারদের সহযোগিতায় আর্মিরা এক স্কুলমাস্টারকে তার বাড়িতে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখে। সে লাশ দাফন করতে কেউ এগিয়ে আসার সাহস পায়নি। আস্ত লাশ পচে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। প্রভাবশালী রাজাকাররা তার করে নেয়-


বাড়িটি দখল লোকটা ছিল একটা সাদামাটা স্কুলমাস্টার, দেশে কী হচ্ছে, কী হতে যাচ্ছে তার কিছুই বুঝত না। উঠোনে এখন যে হাস্নাহেনা গাছটা ঝামরে উঠেছে ঠিক ওইখানে মাটির উপর লোকটার লাশ পড়েছিল দিনের পর দিন। পচেখসে একাকার, গন্ধে ত্রিসীমানায় ঘেঁষা যেত না এ বাড়ির। শেষ পর্যন্ত লোকটা বোধ হয় মাটিতেই মিশে গিয়েছিল কেউ সৎকার করেনি ভয়ে। (কালো মাফলার)'


১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর চেয়েও বিপজ্জনক দিল রাজাকার- আলবদররা। তারাই পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে খবর দিত। টুলটুল বাড়ি আসার পথে তার সঙ্গে দেখা হয় একজন রাজাকারের। পরে সেই রাজাকার কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে এসে তল্লাশি চালায় মনোয়ারের ঘরে। তাদের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে গণপিটুনিতে শহীদ হয় টুলটুল। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন সহজ ছিল না। গল্পটিতে মনোয়ারের কাছে টুলটুলের বলে যাওয়া কথায় পাওয়া যায়-


আমাদের জীবন খুব সুখের নয় টুলটুল বলছিল; কথাগুলো শোনাচ্ছিল কান্নার মতো। জোর করে সহজ হতে চাচ্ছিল, পারছিল না। না পাবারই তো কথা। এই সেদিনের সেই একফোঁটা ছেলে, জীবনকে বাজি রেখে জুয়া খেলায় যতই মেতে উঠুক নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কতটুকু সাহস সে দেখাতে পারে। (কালো মাফলার)'


'কালো মাফলার' গল্পটির বিষয় হিসেবে এসেছে কালো মাফলার পরিহিত মুক্তিযোদ্ধা টুলটুলের সাধারণ মানুষের হাতে চোর সন্দেহে নির্মম মৃত্যুবরণের প্রসঙ্গ। তার চেতনা প্রবাহিত হয়েছে ভাই মনোয়ারের মধ্যে।


সমালোচনাটি সংগ্রহ করা হয়েছে- বাংলাদেশের ছোটোগল্পে মুক্তিযুদ্ধ; লেখক- সোহেল রানা; আগামী প্রকাশনা, প্রথম প্রকাশ ২০২১, ফেব্রুয়ারি। পৃষ্ঠা- ৯৭-৯৯; ISBN NO- 978 984 04 2575 4

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন