বা 'মেঘনাদবধ কাব্য'-এর প্রকৃত নায়ক কে আলোচনা করো।
উত্তর: নতুন জীবনমন্ত্রে তেজোদীপ্ত ও বীরত্বের পূর্ণবেগ নিয়ে উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) এর আবির্ভাব। তাঁর জীবনী তাঁর সাহিত্য কর্মের মতোই বহু বিচিত্র ও বিস্ময়কর। তিনি মহাকবি ও গীতিকবি। তবে মহাকাব্য রচনাতেই তিনি কৃতিত্ব অর্জন করেছেন বেশি। তাঁর রচিত 'মেঘনাদবধ কাব্য' একটি সার্থক মহাকাব্য।
'মেঘনাদবধ কাব্য'-এর নায়ক চরিত্র বিচার: মহাকাব্য মূলত নায়কনির্ভর। নায়ককে কেন্দ্র করেই মহাকাব্য রচিত হয়। তাকে ঘিরেই মহাকাব্যের ঘটনাস্রোত প্রবাহিত হয় এবং মহাকাব্যের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, জটিল আবর্তের বৃত্ত নির্মিত হয়। তাই যথার্থ মহাকাব্যে নায়ক চরিত্রে যদি কোনো অস্পষ্টতা বা সংশয়ের অবকাশ থাকে তবে মহাকাব্যের পরিকল্পনা অনেকাংশে ব্যর্থ হয়ে যায়। 'মেঘনাদবধ কাব্য'-এর প্রকৃত নায়ক কে, এ নিয়ে একটু অস্পষ্টতা রয়েছে। কাকে যথার্থ নায়কের মর্যাদা দেয়া যায় এ নিয়ে বিচার বিতর্কের অবতারণা করা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে গোটা কাহিনীর নিয়ন্ত্রক শক্তি যিনি, তিনিই নায়ক। নায়ক হবে এমন একটি চরিত্র যিনি থাকবেন সকলের ঊর্ধ্বে। সাধারণ মানুষের সাথে তাঁর তুলনা চলে না। তার মধ্যে ঘটবে একাধিক গুণের সমাহার যা কোনো প্রতিনায়ক বা সাধারণ মানুষের মধ্যে কল্পনা করা যায় না। নায়ক চরিত্র হবেন সর্বগুণে গুণান্বিত। তিনি কাব্যের প্রতিটি ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে সকল ট্র্যাজিক ও করুণ পরিণতির মোকাবেলা করেন। অর্থাৎ যে চরিত্র কাব্যের কেন্দ্রিয় রসটিকে ধারণ করে তিনিই নায়ক। এ সমস্ত যুক্তি বিচারে এবং কাব্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে অর্থাৎ রাম, লক্ষ্মণ, মেঘনাদ ও রাবণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে বোঝা যাবে নায়ক হবার পক্ষে কে যথার্থ উপযোগী।
রামচন্দ্র সীতাকে উদ্ধার করার জন্যে লঙ্কা অবরুদ্ধ করে যুদ্ধের নেতৃত্বদান করেছেন। তাঁর চরিত্রে দেখা যায় উদারতা, ভ্রাতৃস্নেহ ও শিষ্টাচার। কিন্তু বহুগুণের সমাবেশ থাকলেও রামচন্দ্র শক্তিহীন, দৈবনির্ভর এক দুর্বল চিত্তের মানুষ। রামচন্দ্র কাব্য মধ্যে বীররূপে প্রতিষ্ঠা পায় নি। তার চরিত্রে ভীরুতা প্রকাশ পেয়েছে নানা স্থানে-
নাহি কাজ, মিত্রবর, সীতায় উদ্ধারি।
ফিরি যাই বনবাসে। দুর্বার সমরে,
দেব-দৈত্য-নর-ত্রাস, রথীন্দ্র রাবণি!
কেমনে, কহ, লক্ষ্মণ একাকী
যুঝিবে তাহার সঙ্গে।
[ষষ্ঠ সর্গ]
মধুসূদনের রাম ভীরু ও পলায়নপর মানসিকতাসম্পন্ন। এরকম বীর্যহীন দৈবনির্ভর কোনো ব্যক্তি মহাকাব্যের নায়ক হতে পারে না।
লক্ষ্মণ এ কাব্যে একটি সমস্যাপূর্ণ চরিত্র। সর্বপ্রথম লক্ষ্মণের প্রসঙ্গ শোনা যায় দ্বিতীয় সর্গে মহাদেবের মুখে। দ্বিতীয় সর্গ হতে অষ্টম সর্গ (তৃতীয় সর্গ বাদে) ছয়টি সর্গে লক্ষ্মণের প্রসঙ্গ ও ভূমিকা পরিব্যাপ্ত। ষষ্ঠ সর্গ ছাড়া লক্ষ্মণের প্রসঙ্গ এ কাব্যের সর্বত্র কবি কল্পলোকে এক পরম শ্রদ্ধা ও মর্যাদার পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছে। লক্ষ্মণকে মধুসূদন বীর চরিত্র হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। লক্ষ্মণ অনেক বেশি শক্তিশালী। তার চরিত্রে বীরত্ব ও দেবভক্তি সমন্বিত হয়েছে। লক্ষ্মণের বীরত্বে স্বয়ং রাবণ প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করেছে-
বাখানি
শক্তিধরাধিক শক্তি ধরিস সুরথী
তুই; কিন্তু নাহি রক্ষা আজি মোর হাতে!"
[সপ্তম সর্গ]
কিন্তু মেঘনাদ নিধনে লক্ষ্মণ যে কাপুরুষতার পরিচয় দিয়েছে তা নায়কসুলভ নয়। লক্ষ্মণের ঔদার্য ও নির্ভীকতা যেমন প্রশংসনীয়, তেমনি কাপুরুষতা ও নৃশংসতাও নিন্দনীয়। তাই লক্ষ্মণকে নায়কের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা যায় না।
'মেঘনাদবধ কাব্য'-এর কেন্দ্রীয় ঘটনা হলো লক্ষ্মণ কর্তৃক মেঘনাদকে নির্মমভাবে হত্যা। তাঁর মৃত্যুকে বর্ণনা করাই হচ্ছে কাব্যের মূল উদ্দেশ্য। মেঘনাদ ছিল কবির একান্ত প্রিয় পাত্র। মেঘনাদ সম্পর্কে কবির উক্তি 'My favorite Indrogit'। হয়তো সেজন্যেই কাব্যখানির নাম 'মেঘনাদবধ' এবং মেঘনাদের নিধন কাহিনী এর কেন্দ্রীয় ও প্রধান ঘটনা। আর সে কারণেই এর নায়কের আসনে সাধারণ পাঠকের পক্ষে মেঘনাদকে বসানোই একান্ত স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে নায়ক মেঘনাদ কি-না সে বিচার করার জন্যে নায়ক বিচারের প্রধান দুটি দিক আমাদের সাহায্য করতে পারে। এ দিক দুটি হচ্ছে-
২. রস নিষ্পত্তিগত দিক।
'মেঘনাদবধ কাব্য' নয়টি সর্গে বিভক্ত। কবি মধুসূদন দত্তের মানস পুরুষ মেঘনাদের মৃত্যু হয়েছে ষষ্ঠ সর্গে এবং সেই সাথে শেষ হয়েছে তার অপূর্ব বীরত্ব এবং গভীর দেশপ্রেম। অথচ এর পরেও কাব্যখানি সংযোজিত হয়েছে তিনটি সর্গে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হলো, মেঘনাদ নিধনই যদি এ কাব্যের কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য হয় তবে ষষ্ঠ সর্গেই কাহিনী কেন শেষ হলো না? নয় সর্গের তিনটি সর্গে মেঘনাদ স্থান পেয়েছে আর রাবণ সমগ্র কাব্যে বিস্তৃত।
রাবণ চরিত্রে কবি প্রবল বীরত্ব এবং দেশপ্রেমের চিত্র এঁকেছেন। অন্ধ নিয়তির নিষ্ঠুরতার কারণ সে জানে না। রাবণের উক্তিতে আত্মকৃত অন্যায় এবং পাপবোধ সংক্রান্ত জিজ্ঞাসা আছে, কিন্তু তার চেতনায় পাপ সম্পর্কে কোনো সজ্ঞানতা নেই। সীতাকে যে অপহরণ করে নিয়ে এল সে সম্পর্কেও রাবণের অপরাধ বোধ নেই। সে দোষারোপ করেছে সূর্পণখাকে। সূর্পণখা পঞ্চবটী বনে লক্ষ্মণকে দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। কিন্তু লক্ষ্মণ তার 'নাসিকা কর্তন' করায় রাবণ সীতাকে অপহরণ করে। আবার কুসুমদাম সজ্জিত দীপাবলী তেজে উজ্জ্বল নাট্যশালা রূপ সুন্দর লঙ্কাপুরীর সমস্ত দেউটি কেন যে নিভে যাচ্ছে তার কারণও সে খুঁজে পায় না-
হা পুত্র, হা বীরবাহু, বীর-চূড়ামণি।
কি পাপে হারানু আমি তোমা হেন ধনে?
কি পাপ দেখিয়া মোর, রে দারুণ বিধি,
হরিলি এ ধন তুই?
[প্রথম সর্গ]
মেঘনাদের মৃত্যুতে পিতা রাবণ যে দুঃখ পেয়েছে, মেঘনাদকে ঘিরে তার পাষাণ হৃদয়ে সৃষ্টি হয়েছে সে আর্ত হাহাকার, জ্বলে উঠেছে প্রতিহিংসার আগুন-তা বর্ণনা করার জন্যেই শেষ তিনটি সর্গের অবতারণা। নায়ক অর্থে সে চরিত্রকেই বোঝায় যার doing ও suffering সমগ্র কাব্যখানির ভিত্তি বা মূল প্রতিপাদ্যরূপে বর্ণিত হয়ে থাকে। কাব্যটিতে doing এবং Suffering এর যতকিছু ভার তার সবই রাবণ বহন করেছে। মেঘাবৃত অন্ধকার আকাশের বুকে বলাকা যেমন অতিশয় লক্ষণীয় হয়েও আকাশের মসীবর্ণকে গাঢ়তর করে তোলে, এ কাব্যের সাক্ষাৎ নায়ক মেঘনাদও তেমনি তার পশ্চাতে রাবণ ভাগ্যের বিস্তৃত পটভূমিকে গাঢ়তর বর্ণ বৈভব দান করেছে। রাবণের বিশাল বক্ষের ক্ষতস্থল রূপে মেঘনাদ ও তদসম্পর্কিত সব উজ্জ্বল লোহিতরাগ ধারণ করেছে।
কবির ইচ্ছা ছিল 'গাইব মা বীররসে ভাসি মহাগীত।' কিন্তু কাব্যের সমাপ্তিতে কবি তাঁর ইচ্ছাকে ঠিক রাখতে পারেন নি। আর পারেন নি বলেই কাব্যখানি বীর রস প্রধান না হয়ে করুণ রস প্রধান হয়েছে। এরকম রসকে ধারণ করে আছে রাবণ। মেঘনাদের মৃত্যুজনিত দুঃখ, লঙ্কার বিপর্যয়ের দায়-দায়িত্ব এবং পরাজয়ের গ্লানি এক সাথেই ধারণ করে আছে রাবণ, মেঘনাদ নয়। কেন্দ্রীয় করুণ রসে ইন্দ্রজিতের কোনো ভূমিকাই নেই। সুতরাং এ ক্ষেত্রে মেঘনাদ নয়, রাবণই নায়ক।
আবার ট্র্যাজেডির নায়কের বৈশিষ্ট্যের বিচারের মাধ্যমে এ কাব্যের প্রকৃত নায়ক বিচার সম্ভব। এরিস্টটল এর মতে ট্র্যাজেডির নায়কের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ-
২. ট্র্যাজেডির নায়ক হবেন ধীরোদাত্ত; গুণান্বিত এবং সদ্ব্যংশজাত।
৩ . ট্র্যাজেডির নায়কের চরিত্রে দোষ-গুণ উভয়ই থাকতে পারে।
৪. ট্র্যাজেডির নায়ক doing ও Suffering এ ভুগবেন এবং এর ফলে তার জীবনে নেমে আসবে যন্ত্রণা।
৫. ট্র্যাজেডির নায়ক হবেন অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত।
উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যের প্রায় সবগুলোরই সমাবেশ ঘটেছে রাবণ চরিত্রে। বীরবাহুর মৃত্যুর পর রাবণের অনুমতিতেই মেঘনাদ যুদ্ধে গিয়েছিল। লক্ষ্মণকে হত্যা রাবণই করেছিল। কেন্দ্রিয় ঘটনা মেঘনাদ হলেও রাবণই ঘটনার নিয়ন্তা। রাবণের একমাত্র অন্যায় হলো সীতা হরণ। সীতা হরণের পাপ নিয়ে এসেছে তাঁর ঐশ্বর্যময় জীবনে করুণ পরিণতি। তার জন্যে তিনি doing এবং suffering এ ভুগেছেন। রাবণ যখন তার প্রিয়জনদের একে একে হারায় তখন রাবণের মধ্যে দেখা যায় চরম অন্তর্দ্বন্দ্ব। নিজেই নিজেকে দায়ী করেছে আপনজন হারানোর জন্যে। গঠনগত ও রসগত দিক হতে তো বটেই এরিস্টটল ও অন্যান্য তাত্ত্বিকদের সংজ্ঞা অনুযায়ী রাবণই নায়ক।
মহাকাব্যটিতে কবি সজ্ঞানে মেঘনাদকে নায়কের আসনে বসালেও নিজ্ঞানে রাবণই তার সমগ্র কল্পনালোক অধিকার করে ছিল। তাকে নিয়েই কাব্যের আরম্ভ এবং শেষও তাকে নিয়েই। রাবণই সকল ঐশ্বর্যের অধিকারী, জয়-পরাজয়ের কীর্তি, অকীর্তির ফলভোগী; শত্রুর সাথে সন্ধি বিগ্রহও সেই করেছে; এ কাব্যের পরিণামও রাবণের পরিণাম, ইন্দ্রজিৎ সে পরিণামকে দারুণতম করেছে মাত্র। অতএব কবির সজ্ঞান অভিপ্রায় যাই হোক এবং মেঘনাদের জীবন যতই সুন্দর ও মৃত্যু যতই করুণ হোক-এ কাব্যে সে যে কেবলই উপলক্ষ মাত্র, লক্ষ্য যে রাবণ তা স্পষ্ট। তাই রাবণই এ কাব্যের যথার্থ নায়কের মর্যাদায় আসীন এবং রাবণই নায়ক।