প্রশ্ন: 'বই কেনা' প্রবন্ধের মূল বক্তব্য নিজের ভাষায় গুছিয়ে লেখ।
বুদ্ধিদীপ্ত ও হাস্যরস সমৃদ্ধ রম্য রচয়িতা হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তাঁর মজলিসী লেখার অনবদ্য সংকলন 'পঞ্চতন্ত্র' গ্রন্থ থেকে সংকলিত 'বই কেনা' প্রবন্ধটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম রম্যরচনা। আলোচ্য রচনায় লেখক হালকা বৈঠকি মেজাজে ও লঘুচালে লেখা এক ধরনের রসাত্মক বাচনভঙ্গির সাথে বিদ্রূপাত্মক আক্রমণের মিলন ঘটিয়েছেন অত্যন্ত সুনিপুণভাবে। বিদ্রূপের ভাষা ব্যবহারে লেখক অনুসরণ করেছেন রোমান কবি হোরেসকে (Horace)। ফলে ‘বইকেনা' প্রবন্ধটি হয়ে উঠেছে এক অনবদ্য ব্যঙ্গাত্মক রচনা।
জাতীয় উন্নতি ও সার্বিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য প্রয়োজন সমগ্র জাতির জ্ঞান তৃষ্ণাকে জাগ্রত করা। লেখক উপলব্ধি করেছেন, জ্ঞানতৃষ্ণা বাঙালি জাতির মধ্যে প্রবল । সেই জ্ঞানতৃষ্ণা মিটানোর জন্য বই কেনা ও বই পড়ার জন্য সকলকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস পেয়েছেন তিনি 'বই কেনা' প্রবন্ধে । নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হল ।
কোন জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানবিক মূল্যবোধ তথা সার্বিক উন্নতির মানদণ্ড হচ্ছে তার জ্ঞানতৃষ্ণা। পৃথিবীর ইতিহাসে যে জাতি জ্ঞান বিজ্ঞানে যত বেশি অগ্রগামী সে জাতি তত উন্নত। ধর্ম, দর্শন, সমাজতত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্বে সুপণ্ডিত সৈয়দ মুজতবা আলী দেশে বিদেশে ঘুরে এ মহাসত্যটি উপলব্ধি করেছিলেন মর্মে মর্মে। জাতি হিসেবে বাঙালির জ্ঞানতৃষ্ণা ও রসবোধের অভাব না থাকলে ও বই কেনায় তার অদ্ভুত অনীহায় লেখক অত্যন্ত পীড়িত। তাই আলোচ্য রচনায় লেখক বই কেনার ক্ষেত্রে বাঙালির মর্মান্তিক ঔদাসীন্যকে আঘাত করেছেন রম্য ভঙ্গিতে অথচ বিদ্রূপের বানে।
'বই কেনা' প্রবন্ধে লেখক প্রথমেই ব্যক্তির আত্মিক বিকাশ এবং সামাজিক অগ্রগতিতে বইয়ের অপরিহার্যতা তুলে ধরেছেন। লেখক তাঁর বক্তব্যকে নিছক ফাঁকা বুলি হিসেবে ছুড়ে দেননি। বরং, তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে তিনি অত্যন্ত জোরালো এবং কার্যকর যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। তিনি আনাতোল ফ্রাঁস, বার্ট্রান্ড রাসেল, ওমর খৈয়াম, মার্ক টুয়েন প্রভৃতি পণ্ডিত মনীষীদের দৃষ্টিতে বই পড়া ও জ্ঞানচর্চার গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। মুসলমান, খ্রিস্টান এবং হিন্দুদের প্রধান ধর্মগ্রন্থে কিভাবে বিদ্যাচর্চাকে মহিমান্বিত করা হয়েছে সে বিষয়েও তিনি আলোকপাত করেছেন। এরপর লেখক বই কেনায় বাঙালির অনীহার বাস্তব কারণ অনুসন্ধান, বইকে সুলভ করার ক্ষেত্রে ক্রেতার ভূমিকা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ও ভাবগম্ভীর বিষয়কে উপস্থাপন করেছেন রসদীপ্ত ভাষায় ও বৈঠকি গল্পের ঢঙে। এভাবেই লেখক বিভিন্ন দিক থেকে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সুশীল জাতি গঠনে বই কেনা ও বই পড়ার অপরিহার্যতা প্রমাণ করেছেন ।
রসবোধ, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বর্ষণের নৈপুণ্য, খোশ-গল্প পরিবেশনের দক্ষতা ও শব্দ প্রয়োগ-কুশলতায় 'বই কেনা' বাংলা সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রম্যরচনার নিদর্শন হয়ে আছে ।