পিতার নাম : মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
মাতার নাম : সারদা দেবী।
পিতামহের নাম : প্রিন্স দ্বারকনাথ ঠাকুর।
শিক্ষাজীবন : রবীন্দ্রনাথ বাল্যকালে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি, সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করলেও স্কুলের পাঠ শেষ করতে পারে নি। ১৭ বছর বয়সে ব্যারিস্টারি পড়তে ইংল্যান্ড গেলেও কোর্স সম্পন্ন করা সম্ভব হয় নি। তবে গৃহ শিক্ষকের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জনের কোনো ত্রুটি হয় নি।
পেশা / কর্মজীবন : ১৮৮৪ খ্রি. থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতার আদেশে বিষয়কর্ম পরিদর্শনে নিযুক্ত হন এবং ১৮৯০ থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারি দেখাশুনা করেন। এ সূত্রে তিনি কুষ্টিয়ার শিলাইদাহ ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর দীর্ঘ সময় অবস্থান করেন।
ছদ্মনাম : ভানুসিংহ ঠাকুর।
জীবনাবসান : মৃত্যু তারিখ : ৭ আগস্ট, ১৯৪১(২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ)
সাহিত্যকর্ম
কাব্য : সন্ধ্যা সঙ্গীত, প্রভাত সংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল, মানসী, সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী, ক্ষণিকা, নৈবদ্যে, গীতাঞ্জলি, বলাকা, পূরবী, পুনশ্চ, বিচিত্রা, সেঁজুতি, জন্মদিনে, শেষলেখা (মৃত্যুর পর প্রকাশিত) বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
উপন্যাস : গোরা, ঘরে-বাইরে, চতুরঙ্গ, চোখের বালি, নৌকাডুবি, যোগাযোগ, রাজর্ষি, শেষের কবিতা প্রভৃতি।
কাব্যনাট্য : কাহিনী, চিত্রাঙ্গদা, বসন্ত, বিদায়, অভিশাপ, বির্সজন, রাজা ও রাণী প্রভৃতি।
নাটক : অচলায়তন, চিরকুমার সভা, ডাকঘর, মুকুট, মুক্তির উপায়, রক্তকরবী, রাজা প্রভৃতি।
গল্পগ্রন্থ : গল্পগুচ্ছ, গল্পস্বল্প, তিনসঙ্গী, লিপিকা, সে কৈশোরক প্রভৃতি।
প্রবন্ধগ্রন্থ :বিচিত্র প্রবন্ধ, শিক্ষা, শব্দতত্ত¡, কালান্তর, সভ্যতার সংকট।
ভ্রমণ কাহিনী : জাপানযাত্রী, পথের সঞ্চয়, পারস্য, রাশিয়ার চিঠি, যুরোপ যাত্রীর ডায়েরী, য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র।
পত্র সাহিত্য ছিন্নপত্র, রাশিয়ার চিঠি, ভানুসিংহের পদাবলী, চিঠিপত্র।
দুই বিঘা জমি কবিতার মূলভাব
দুই বিঘা জমি কবিতায়
কবি শোষক আর শোষিত শ্রেণির স্বরূপ তুলে ধরেছেন। পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত-
ক. শোষক
খ. শোষিত
সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থায়
ধণিক শ্রেণি ক্রমশ ধনী ও সাধারণ শ্রেণি। সাধারণ শ্রেণি বরাবর সমান্তবাদী প্রভুদের দ্বারা
নির্যাতিত, নিষ্পেষিত। কবির এই কবিতায় উঠে এসেছে নির্যাতিত এক কৃষকের কথা। কবি নিজেও
জমিদার ছিলেন কিন্তু তার হৃদয়ে ছিল সকলের জন্য ভালোবাসা। কবিতাটির মূল কথাগুলো
এতটাই বাস্তব যে আজকের সমাজের সাথে অনায়াসেই মিলিয়ে নেওয়া যায়। কবিতাটি শুরু হয়েছে
এভাবে- ‘শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই/আর সবই গেছে ঋণে।/বাবু কহিলেন, বুঝেছ উপেন? এ
জমি লইবো কিনে।’
কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন। আর এখানেই সেই ‘উপেন’ চরিত্রটি চিত্রিত হয়েছে। এখানে উপেন চরিত্রটি আসলে কে? এটি কি কবির দেখা কোনো নিগৃহীত চরিত্র? যদি তা নাও হয়, তাহলেও উপেন পৃথিবীর ক্ষমতার কাছে সব হারানোদের প্রতিকৃতি। ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় কবি উপেন নামক একজন হতদরিদ্র এবং যার সব জমিই ধারকর্জ বা ঋণে খোয়া গেছে তার কাতর উক্তি দিয়ে শুরু করেছেন। বিপরীতে সেই সর্বভোগ মানসিকতার বাবু বা মহাজন হলো আজকের সমাজের ধনীক শোষক শ্রেণির এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। যারা সর্বদাই অসহায়ের সম্পদের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এখানে একজন জমিদার বা মহাজন যার লোভী নজর উপেন নামক সেই হতভাগ্য মানুষের সামান্য জমির ওপর। এই জমিটুকুই তার বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন। আর কবির কবিতাটি এমন একটি সমাজ বাস্তবতায় সেই তৎকালীন জমিদার বা মহাজন শ্রেণির সমাজ থেকে আজ অবধি বহমান। তৎকালীন সমাজে বিভেদ ছিল আরও প্রবল। যেখানে মহাজন বা জমিদার অথবা ভূস্বামী শ্রেণির শাসন ও শোষণে দরিদ্র অভুক্ত মানুষের জীবনযাপন করতে হতো। তাদের লোভে ঘর ছাড়তে হয়েছে অসহায় বহু মানুষকে। জমিদারের সামনে হাতজোড় করে ভিক্ষা চাওয়াই ছিল এক ধরনের রীতি। তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়ানোর সাহস সচরাচর কেউ দেখাতো না। সেখানে উপেনের করুণ আর্তি জমিদারের কানে পৌঁছালেও তাতে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করার কোনো কারণ নেই! কারণ উপেনের মতো মানুষের যে তার বিরুদ্ধে কিছু করার নেই এমনকি জোর করে প্রতিবাদটুকুও করার ক্ষমতা নেই সেটা এই অত্যাচারী ধনীক শ্রেণির ভূস্বামী ভালোই অনুধাবন করতে পারেন। বরং উপেন যে মুখের ওপর ‘না’ বলেছে এটুকুতেই তিনি বেশ বিরক্ত। উপেনের জমি মাত্র দুই বিঘে রয়েছে যা থেকে সে তার পরিবারের ভরনপোষণ যোগায় এবং মাথা গোঁজার ঠাঁই সেই কথা জেনেও সেটুকু নেওয়ার জন্য ভূস্বামী তথা সেই মহাজনের লোভ তীব্র হয়ে ওঠে। তিনি উপেনের অনুমতির অপেক্ষা করেননি। সে প্রশ্নও আসে না।
উপেন যখন কাতভাবে জানায় যে- ‘কহিলাম আমি, তুমি ভূস্বামী,
ভূমির অন্ত নাই-/চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই।’
একথা শোনার পর ভূস্বামীর মনে কোনো করুণার উদ্রেক হয় না উপরন্তু তার যে ওই দুই বিঘা জমি না পেলে তার শখের বাগান দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে মিলছে না সেকথাই উপেনকে দৃঢ় কণ্ঠে জানায়।
‘শুনি রাজা কহে, বাপু জানো তো হে, করেছি বাগানখানা/পেলে দুই
বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা।/ওটা দিতে হবে।’
উপেনের একমাত্র সম্বল ওর ওই ভিটেমাটি হারাতে হবে জেনে সে সজল
চোখে জমিদারের করুণা ভিক্ষা চায়। কিন্তু তার করুণার উদ্রেক হয় না কোনোভাবেই। এসব
অসহায় মানুষের প্রতি করুণার নজিরও খুব বেশি নেই। বরং অসহায়ের সবটুকু দখল করেই যেন
তার পৈশাচিক তৃপ্তি। এই চিত্রের সাথে আজকের তথাকথিত আধুনিক সমাজের কি খুব বেশি
পরিবর্তন ঘটেছে? জমিদার প্রথা আর নেই। কিন্তু জমিদারি মানসিকতা কি বিদায় নিয়েছে?
উপেনের মতো অসহায়, দরিদ্র মানুষ কি আজও এরকম কিছু মানুষের কবলে পরে ভিটেমাটি ছাড়ছে
না? এ হলো কবিতা মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা সমাজ বাস্তবতা। ওই সময়ে পুঁজিবাদের ধারণা
বিকশিত হয়নি। এখন হচ্ছে। যতই পুঁজিবাদী ধারণা বিকশিত হচ্ছে ততই ফিরে আসছে ধনীক
শ্রেণির মানসিকতা। সহায় সম্বলহীনের সাথে অত্যাচার বাড়ছে। মিথ্যে দেনার খাতে যখন
উপেনের ভিটে মাটি সব কব্জা করে নেয় সেই লোভী জমিদার তখন উপেনের পথে নামা ছাড়া আর
কোনো গতন্ত্যর থাকে না। কারণ সেই ভিটেমাটিটুকুই ছিল তার একমাত্র সম্বল। সেই
বিখ্যাত উক্তি যা আজও মানুষের মুখে মুখে রয়েছে তা এই দুই বিঘা জমি কবিতার।
‘এ জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি/রাজার হস্ত করে
সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’
যার সমাজে আজ অর্থের জোরে রাজার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বসে আছেন
তাদের অনেকেই সেই ভূস্বামীর ভূমিকাই সমাজে রয়ে গেছেন। একটি কবিতা একটি ঘটনা, সমাজ
বাস্তবতা, ব্যক্তিগত নিরীক্ষণ, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, প্রতিকূলতা, ব্যর্থতা,
অন্তর্দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম প্রভৃতি কেন্দ্র করে লেখা হয়। সেই লেখা যে কেবল সেই
সময়েরই অন্তভূক্ত থাকবে তার কোনো অর্থ নেই। লেখা কালের গণ্ডি উত্তীর্ণ হলেই তা
জীবিত। দুই বিঘা জমি কবিতাটি তো শুধু একটি কবিতা নয় বরং আজও অসহায় মানুষের জমি যা
উপেনরা রক্ষার প্রচেষ্টা করছে প্রতিদিন। দুই বিঘা জমিতে যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা
কাল থেকে কালে বহমান স্রোতধারা। দুই বিঘা জমি কবিতায় ভিটেমাটি হারিয়ে দেশান্তরী
হওয়ার পর নানা স্থানে ঘুরলেও তার সেই সামান্য জমির কথা কিছুতেই ভুলতে পারে না।
কারণ স্বদেশের মাটির টান যে এরকমই হয়। একদিন সেখানে ফিরে আসার ইচ্ছা জাগে মনে। তাই
সেই টানে উপেনও ফিরে আসে একদিন। কিন্তু এখানে বাস্তবতা হলো সময় পরিবর্তনশীল। একদিন
যা অন্যায়ের কাছে ছেড়ে গেছে সেই মাটি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। একদিন যে
ভিটেমাটিটুকু উপেনের আশ্রয় ছিল ততদিনে তা সেই ভূস্বামীর দখলে শোভা বর্ধন করছে।
সেদিনের উপেনের ফেলে যাওয়া মাটির চিহ্ন সে কোথাও খুঁজে পায় না। তার থেকেও বড়
প্রহসন হলো উপেনের সামনে যখন তারই গাছ থেকে একটি আম পরে এবং উপেন তা হাতে নেয় তখন
রাজার মালী এসে তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং চোর স্বাব্যস্ত করে। এর থেকে বড় প্রহসন আর
কী হতে পারে! সময় এমনই! সাধুকে চোর আর চোরকে সাধুতে পরিণত করতে পারে! উপেনের মতো
অনেক হতভাগ্য মানুষের তাই আজো এমন অপবাদ সহ্য করতে হয়। এমনিভাবে সমাজে সমাজের
রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ভোগবাদী মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় তার সাথে এই কবিতার চিত্রই
স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের সামনে।
কৃতজ্ঞতা: আলোক আচার্য (দুই বিঘা জমি; একটি সমাজ নিরীক্ষা)