মধ্যযুগের সাহিত্যে রোমান্টিক প্রণয় কাহিনীমূলক কাব্যধারা বৈশিষ্ট্য ও পরিচয়

 




প্রশ্নঃ মধ্যযুগের সাহিত্যে রোমান্টিক প্রণয় কাহিনীমূলক কাব্যধারার বৈশিষ্ট্য ও পরিচয় লিপিবদ্ধ কর।

 

উত্তরঃ

মধ্যযুগের বাংলা রোমান্টিক কাব্য সুচারু শিল্প কলা, সূক্ষ্ম সৌন্দর্যবোধ ও নির্মল আনন্দরসের মানস সম্পদ। ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালী সংস্কৃতি যে দীপ্যমান হয়ে উঠেলি তার ধারক এবং বাহক মুসলমান কবিরাই। মধ্যযুগে হিন্দু কবির রচনায় জীবনের স্বাধীন ব্যাখ্যা নেই।

 

দেব চরিত্রের প্রভাবে এবং প্রকোপে মানব চরিত্র আড়ষ্ট। অথচ মুসলমান কবিদের আখ্যায়িকা কাব্যে ধর্মের কথা থাকলেও মানব চরিত্রের কোথাও দেবত্ব আরোপ করা হয় নি। এর প্রধান কারণ ইসলাম ধর্মে অবতার বাদের স্থান নেই। ঐতিহ্য থেকে অর্থাৎ আরবী, ফারসী, হিন্দী সাহিত্যের উপকরণ নিয়ে কাব্যের বস্তু সংগ্রহ করা হলেও কাব্যগুলোতে ধর্মের ছোঁয়াচ নেই। আছে বলিষ্ট জীবনবাদ। মধ্যযুগে মুসলিম কবি বিরচিত রোমান্টিক কাব্যগুলোতে মানব প্রেমের স্বর্ত-স্ফুর্ত ভোগ, স্বর্গমর্ত আকৃতির স্বপ্ন সোৗন্দর্য ও আনন্দলোক রচিত হয়েছে। নিম্নে মুসলিম কবি বিরচিত রোমান্টিক কাহিনী কাব্য সম্বন্ধে আলোচনা করা হলোঃ

 

১) শাহ মুহম্মদ সগীরঃ ইউসুফ-জোলেখা

রোমান্টিক কাব্যের রচনাকালের পরিধি মধ্যযুগ থেকেই। মধ্যযুগের বাংলা রচনার নিদর্শন পাই বৌদ্ধ শতক থেকে। এ শতকের শেষের দিকে অথবা পনের শতকের গোড়াতেই শাহ্ মোহাম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ জুলেখা’ দ্বারা এর প্রথম দ্বার উন্মোচিত হয়। গৌড়ের সুলতান গিয়াস উদ্দীন আযম শাহের রাজত্বকালে কবি এ কাব্যটি রচনা করেছিলেন। ‘ইউসুফ-জুলেখা’র প্রণয় কাহিনী সুপ্রাচীন। পবিত্র কোরানে ও বাইবেলে প্যারাবল বা নৈতিক উপাখ্যান হিসেবে এ কাহিনী সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। এ মূল কাহিনীকে পল্লবিত করে ইরানের মহাকবি ফেরদৌসী এবং সুফি কবি জামি কাব্য রচনা করেছেন। সগীরের কাব্য ফেরদৌসীর কাব্যের ন্যায় রোমান্টিক। কবির মূল প্রেরণা ছিল ফারসী কাব্যাদর্শ। আর ‘ইউসুফ-জুলেখা’ ভারতীয় সাহিত্যের প্রথম লৌকিক মানবীয় প্রণয়োপাখ্যান। এছাড়া ‘ইউসুফ-জুলেখা’র আরও পাঁচজন রচয়িতার নাম পাওয়া যায়। আব্দুল হাকিম, গরীবুল্লাহ, গোলাম সফিউল্লাহ, সাদেক আলী ও ফকির মুহম্মদ। এদের মধ্যে আব্দুল হাকিম ও গরীবুল্লাহর রচনা কিছুটা উৎকৃষ্ট।

 হুযুর কেবলা গল্পের আলোচনা এখানে

২) দৌলত উজীর বাহরাম খানঃ লাইলী মজনু

খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে মানবীয় প্রণয়োপাখ্যানমূলক কাব্য কাহিনী রচনা করে যে সমস্ত কবি প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন তাঁদের মধ্যে দৌলত উজির, বাহরাম খাঁন উল্লেখযোগ। শুধু আমাদের দেশের সাহিত্য নয়, পৃথিবীর সমস্ত প্রেমকাহিনীর মধ্যে ‘লাইলী মজনু’র প্রেমকাহিনী উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীর পরিচিত সব ভাষায় এ কাহিনী নানাভাবে পদ্যে এবং গদ্যে বিবৃত হয়েছে। কবি দৌলত উজির বাহরাম খাঁন রচিত ‘লাইলী-মজনু’ কাব্য ফারসী কবি জামীর ‘লাইলী-মজনু’ নামক কাব্যের ভাবানুবাদ।

 

৩) মুহম্মদ কবীরঃ মধু মালতী

রোমান্টিক কাহিনী কাব্য রচনা করে যে সমস্ত মুসলমান কবি বাংলা সাহিত্যে বৈচিত্র্য সম্পাদনে এবং সাহিত্য রসকে রুচি পরিবর্তনে সাহায্য করেছেন তাঁদের মধ্যে মুহম্মদ কবির অন্যতম। রাজকুমার মনোহর ও রাজকুমারী মধু মালতীকে অবলম্বন করে কবির ‘মধুমালতী পুঁথির বিষয়বস্তু, রোমান্টিক প্রেম কাহিনী এবং তা রক্তে-মাংসে গর্বিত মানব-মানবীর প্রেম। মোহাম্মদ কবিরের মৌলিকত্ব ও কৃতিত্ববোধের রিচয় ‘মধুমালতী’ কাব্যে উজ্জ্বল। মুহম্মদ কবির রচিত ছাড়াও আরও ছয়জন কবির ‘মধুমালতী’ উপাখ্যান পাওয়া যায়। এঁরা হলেন সৈয়দ হামজা, শাহের মুহম্মদ, জাবেদ আলী, নূর মুহম্মদ প্রমুখ।

 

৪) সাবিরিদ খাঁনঃ ‘‘ক) বিদ্যাসুন্দর ও খ) হানিফা কয়রাপুরী’’

মধ্যযুগের চট্টগ্রাম অঞ্চলে আবির্ভূত কবিদের মধ্যে সাবিরিদ খাঁন উল্লেখযোগ্য। তাঁর প্রথম রোমান্টিক কাব্য ‘‘বিদ্যাসুন্দর’’ নিছক মানবীয় প্রেমের কাহিনী। বিদ্যাসুন্দর উপাখ্যানের আদি উৎস সংস্কৃত কবি বিলহলের ‘চৌরপঞ্চাশিকা’। রত্মাবলীর রাজার পুত্র সুন্দর এবং কাঞ্চিপুরের রাজার কন্যা বিদ্যাপতির বিচিত্র প্রেমকাহিনী এর অন্তর্গত।

এ কাব্যটি রূপকগীতি নাট্য। তাঁর অপর গ্রন্থ ‘‘হানিফা কয়রাপুরী’’ জঙ্গনামাধর্মী’ কাব্য। হানিফা জয়গুন কয়রাপরির প্রেমের আবরণ দিয়ে সমস্ত গ্রন্থটি মোড়া। এতে রোমান্টিকতার প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্যের ধারার পরিচয় দেখুন

৫) দোনাগাজীঃ সয়ফুলমূলক-বদিউজ্জামান

‘‘সয়ফুলমূলক বদিউজ্জামান’’ কাহিনীর ধারা অনুসরণে মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে মোট ছয়জন কবি কাব্য রচনা করেছেন। দোনা গাজী, আলাওল, ইব্রাহীম, মালে মুহম্মদ প্রমুখ। দোনাগাজীর ‘‘সয়ফলমূলক বদিউজ্জামান’’ প্রণয়োপাখ্যানমূলক কাব্য। এ উপাখ্যানের উৎস ‘আলেফ লাইলা’। এ উপাখ্যানের নায়ক হচ্ছেন মিশরের রাজা শাহ ছিল পুরানের পুত্র মূলক ও নায়িকা পরিরাজ কন্যা বদিউজ্জামান।

 

সয়ফুলমূলক বদিউজ্জামানের ত্রিপট চোখে প্রেমাসক্ত হয়ে পাগল হয়ে যান এবং বাল্যবন্ধু সায়েদ, রাজকুমারের মনের কথা জানতে পেরে রাজার নিকট জানিয়ে দেন। রাজা দেশ-বিদেশে চর পাঠান। সবাই বিফল মনোরথ নিয়ে ফিরে আসেন। পরিশেষে রাজকুমারের সাথে বদিউজ্জামানের মিলন ঘটে। এ গ্রন্থে বহু প্রাচীনত্ব লক্ষ্য করা যায়। ভাষার প্রকৃত ভাব, ছন্দের শিথিলতা, অন্ত্যানুথায়াসের শৈথিল্য, সারল্য, প্রাচীন শব্দ প্রয়োগের বাহুল্য দেখা যায়।

 

৬) দৌলতকাজীঃ সতীময়না-লোরচন্দ্রানী

আরাকানের বৌদ্ধ রাজাদের আনুকূল্যে বাংলা সাহিত্য চর্চা করে যে সমস্ত মুসলিম কবি খ্যাতি অর্জন করেছেন তাঁদের মধ্যে সতের শতকের কবি দৌলত কাজীর নাম সর্বাগ্রে স্মরনীয়। তাঁর সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী কাব্যটি প্রণয়কাহিনী কাব্য ধারার একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। মিয়া সাধন নামে একজন হিন্দী ভাবী মুসলিম কবি বিরচিত ম কাব্যই ছিল কবির এই কাব্য রচনার আদর্শ। এ কাব্যের মূল উপজীব্য বিষয় মানব প্রেম।

 

৭) সৈয়দ আলাওলঃ পদ্মাবতী, সপ্তপয়কর

আরাকানে সপ্তদশ শতকের বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি সৈয়দ আলাওল। রোমাঙ্গ আমাত্য মাগন ঠাকুরে আজ্ঞাক্রমে আলাওল জায়সীর হিন্দী কাব্য ‘পদুমাবত’-এর বঙ্গানুবাদ করে পদ্মাবতী নামক রোমান্টিক কাহিনী কাব্য রচনা করেন। চিতোরের রাজা রতনসেন ও সিংহল রাজকন্যা পদ্মাবতীর বিচিত্র প্রেমকাহিনীর অঙ্গীভূত এই গ্রন্থ।

পারস্য কবি নিজামী গঞ্জতভীর ‘হপ্তপয়কর’ হতে আলাওল ‘সপ্তপয়কর’ নামে আরেকটি রোমান্টিক কাহিনী কাব্য রচনা করেন। আরাকান রাজের সমরমন্ত্রী সৈয়দ মুহম্মদের আদেশে এ গ্রন্থখানি রচিত হয়।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আলোচনা ক্লিক করুন

 

৮) কোরেশী মাগন ঠাকুরঃ চন্দ্রাবতী

বাংলা রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানগুলোর মধ্যে আর একটি উল্লেখযোগ্য কাব্য কোরেশি মাগন ঠাকুরের ‘চন্দ্রাবতী’। ভদ্রাবতী নগরের রাজা চন্দ্রসেনের বীরপুত্র বীরভান সরন্দীপের রাজা শুরপালের সুন্দরী কন্যা চন্দ্রাবতীর প্রেমকথা এ কাব্যের মূল উপজীব্য বিষয়।

 

৯) আব্দুল হাকিমঃ লালমতি সয়ফুলমূলক

আব্দুল হাকিমের লালমতি সয়ফুলমূলক একটি রোমান্টিক প্রণয়কাহিনী। কাব্যখানি সিকান্দারের পুত্র সয়ফুলমূরকের সাথে দেশের রাজকুমারী লালমতির প্রণয়ঘটিত ঘটনাবলী নিয়ে রচিত। গ্রন্থটি ফরাসী উপাখ্যানের অনুবাদ হলেও কবি মৌলিকত্বের দাবী রাখেন।

 

১০) নওয়াজিস খানঃ গুলে বকাওলী

ফার্সী উপাখ্যানের অনুসরণে রচিত সুবিখ্যাত ‘গুলে বকাওলী’ নামক প্রণয়কাহিনী বাংলা সাহিত্যে একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। বাংলা সাহিত্যে উপাখ্যান অনুসারে রচিত কাব্যগুলোর মধ্যে প্রথমে নাম করতে হয় মুহম্মদ নওয়াজিস খানের। এছাড়া মুহম্মদ মুকিম, মুন্সী এমদাদ আলী প্রমুখ কবিগণও এ কাব্য রচনা করেন।

 

সর্বশেষে বলা যায় মধ্যযুগে মুসলিম কবি বিরচিত রোমান্টিক কাহিনী কাব্যগুলোতে অধিকাংশ কাব্যই নির্জলা মানব প্রেমের কাহিনী। মধ্যযুগের পটভূমিকায় আলোচিত মুসলিম কবিদের দান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দারিদ্রতার কারণে যে যুগে হিন্দুরা দেব-দেবীর মাহাত্মন নিয়েই ব্যাপৃত থাকতেন, বিশুদ্ধ মানবীয় প্রণয়ঘটিত ব্যাপার নিয়ে সাহিত্য রচনার কথা তাঁরা ভাবতেও পারতেন না। তাঁদের কাছে সাহিত্য মানেই ছিল ধর্ম সাহিত্য। কিন্তু মুসলিম কবিরা সাহিত্য সাধনার সঙ্গে সকল সময় ধর্মকে জড়াতেন না।

 

সেজন্য রোমান্টিক কাহিনী কাব্য রচনায় তাঁরাই অগ্রণী। ডঃ মুহম্মদ এনামূল হক মুসলিম কবি বিরচিত রোমান্টিক উপাখ্যানগুলোকে সাহিত্যের ক্ষেত্রে মুসলিম ললিত কলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলে মন্তব্য করেছেন।

 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন