প্রাগৈতিহাসিক গল্পের শিল্পমূল্য আলোচনা কর।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক সুপরিচিত নাম। বাস্তব জীবনাভিজ্ঞতার নিরিখে তিনি মানুষের অর্ন্তজগতকে গল্পে প্রাধান্য দিয়েছেন। মানিক সাহিত্যে সর্বাধিক আলোচিত গল্পের নাম “প্রাগৈতিহাসিক”। পোশাক পরা মেকি সভ্যতার আড়ালে যে আদিম স্বভাব আছে, তাকে বিকৃতি ও ভ্রষ্টতা দিয়ে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস এ গল্পে লক্ষ্য করা যায়। জীবনাকাঙ্খার অপূর্ব শিল্প নির্দেশ এই গল্পে আছে। নিন্মে প্রাগৈতিহাসিক গল্পের শিল্পমূল্য আলোচনা করা হল।
দুর্ধর্ষ ডাকাত সর্দার ভিখু নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য ডাকাতি পেশাকে বেছে নেয়। পেশার তাগিদে সে মানুষ খুন করতেও দ্বিধা বোধ করত না। বনের মধ্যে দীর্ঘ দিন যাবত প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। বৈকুণ্ঠ সাহার গদিতে ডাকাতি করতে গিয়ে ভিখু কাধে একটা বর্শার খোচা খেয়ে পঙ্গু হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করেছে, তবু অস্তিত্বে প্রশ্নে সামান্যতম ছাড় দেয় নি। আদিম পশুবৃত্তি কতখানি জটিল ও ভয়াবহ ছিল তা ভিখুর মাধ্যমে লেখক এ গল্পে তুলে ধরেছেন। ভিখুর মত এমন আদিম উদ্দাম জীবন নিয়ে রচিত হওয়ায় বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রাগৈতিহাসিক গল্পটি স্বাতন্ত্রমণ্ডিত।
প্রাগৈতিহাসিক গল্পে মানুষের বেঁচে থাকার প্রবল আকাঙ্খার বিষয়টিও উঠে এসেছে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানুষ বিভিন্ন প্রতিকুলতার সম্মুখীন হয়ে আসছে। তারা এই প্রতিকুলতা অতিক্রম করেছে শুধু নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য। তারা সব সময় জীবন সংগ্রামে রত থেকেছে। এই নিগূঢ় সত্যটি ভিখুর জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এবং পায়ের ঘাকে পুঁজি করে পাঁচীর ভিক্ষাবৃত্তির ম্যাধমে এ গল্পে পরিস্ফুট।
প্রাগৈতিহাসিক গল্পের ভিখু চরিত্র দেখুন
গল্প রচনায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তিনি সাধারণত কাহিনীকে প্রাধান্য দেন না। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক গল্পটি এর ব্যতিক্রম। এ গল্পে তিনি একটি টান টান কাহিনী সৃষ্টি করেছেন। বাইরের প্রতিক্রিয়া ভিখুর মনোজগতকে কীভাবে আলোড়িত করেছে তা দেখানোর জন্যই তিনি এ গল্পের কাহিনী সাজিয়েছেন। তাই কাহিনীর কোন ডাল পালা বের না করে শুধু ভিখুকে কেন্দ্র করেই কাহিনীর শুরু এবং শেষ। সেদিক থেকে প্রাগৈতিহাসিক গল্পের কাহিনী অত্যন্ত সুপরিকল্পিত।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় “প্রাগৈতিহাসিক” গল্পের বিষয় এবং ভিখুর চরিত্রকে বোঝানোর জন্য গল্পের মাঝে মাঝে অতীতের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। ভিখু এক হাত হারিয়ে যখন ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নেয় তখন তার মধ্যে কামনার হিংস্রতা ভর করে। তার মনোগত বাসনার অস্থিরতাকে বোঝানোর জন্য লেখক তার অতীত উন্মত্ত জীবনের কাহিনী তুলে ধরেছেন। যেমন
“রাখু বাগদীর সঙ্গে পাহামার বোনটাকে যেবার চুরি করিয়াছিল সেইবার সাত বছরের জন্য তাহার কয়েদ হইয়াছিল। কিন্তু দু’বছরের বেশি কেহ তাহাকে আটকাইয়া রাখিতে পারে নাই। এক বর্ষার সন্ধ্যায় জেলের প্রাচীর ডিঙ্গাইয়া সে পালাইয়াছিল, তারপর একা একা সে গৃহস্থ বাড়িতে ঘরের বেড়া কাটিয়া সে চুরি করিয়াছে, দিনে পুকুর ঘাটে একাকিনী গৃহস্থ বধূর মুখ চাপিয়া গলার হর, হাতের বালা খুলিয়া লইয়াছে। রাখুর বউকে সঙ্গে নিয়া নোয়াখালি হইয়া সমুদ্র ডিঙ্গাইয়া পাড়ি দিয়াছে একেবারে হাতিয়ায়।”
“প্রাগৈতিহাসিক” গল্পে চরিত্র চিত্রণে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একটি চারত্র অর্থ্যাৎ ভিখুক প্রাধান্য দিয়েছেন। ভিখুর সামগ্রিক বৈশিষ্ট্যকে লেখক এ গল্পে তুলে ধরেছেন। তার কামনা,হিংসা,প্রতিশোধ,স্পৃহা এবং অস্তিত্ব-সংকট উত্তরণের সংগ্রামশীলতা কোনটিই গল্পে বাদ যায় নি। বাকি চরিত্র যেমন পাঁচী, বশির, প্লেহাদ, প্লেহাদের বৌ এবং ভরতকে যেন ভিখুর চরিত্র বিকাশের সহায়করুপে এ গল্পে উপস্থাপিত করেছেন। তবে একটি চরিত্রকে সংক্ষিপ্তভাবেও যে তার প্রায় সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা সম্ভব তা মানিক প্লেহাদের বৌয়ের মাধ্যমে দেখিয়েছেন।
স্বরবৃত্ত ছন্দ কাকে বলে দেখুন
প্লেহাদের বউ ছেলেকে ঘরে শোয়াইতে আসিয়া ভিখুর চাহনি দেখিয়া তাড়াতাড়ি পালাইয়া যাইতেছিল, ভিখূ তাহার একটা হাত চাপিয়া ধরিল। কিন্তু প্লেহাদের বউ বাগ্দীর মেয়ে দুর্বল শরীরে বাঁ হাতে তাহাকে আয়ত্ত করা সহজ নয়। এক ঝটকায় হাত ছাড়াইয়া সে গাল দিতে দিতে চলিয়া গেল। প্লেহাদ বাড়ি ফিরিলে সব বলিয়া দিল।
সমগ্র গল্পে প্লেহাদের বউয়ের বর্ণনা এইটুকু অথচ এর মধ্যেও তার চরিত্রের অনেক বৈশিষ্ট্যকে লেখক পরিস্ফুট করতে সক্ষম হয়েছেন।
“প্রাগৈতিহাসিক” গল্পে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করেছেন। প্রত্যাহিক জীবনে বস্তু বিশ্বের ইতিহাস আছে, প্রকৃতি জগতের পরিচিতি আছে, মানুষ,সভত্যা,পৃথিবী,চাঁদ এদেরও ইতিহাস আছে। কিন্তু মানুষের অন্তর গত অদৃশ্য জগতের সন্ধান আজও অজ্ঞাত। প্রাগৈতিহাসিক গল্পে জীবনবাদী লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সেই অজানা অকথিত প্রাগৈতিহাসিক কাল হতে আগত নিষ্ঠুরতা, পাশবিকতা, জৈবিকতার স্বরুপ অনুসন্ধান করেছেন। মানিকের ভাষায় “হয়তো ওই চাঁদ আর এই পৃথিবীর ইতিহাস আছে। কিন্তু যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ হইতে সংগ্রহ করিয়া দেহের অভ্যন্তরে লুকাইয়া ভিখু ও পাঁচী পৃথিবীতে আসিয়াছিল এবং যে অন্ধকার তাহার সন্তানের মাংসল আবেষ্টনীর মধ্যে গোপন করিয়া রাখিয়া যাইবে তাহা প্রাগৈতিহাসিক। পৃথিবীর আলো আজ পর্যন্ত তাহার নাগাল পায় নাই, কোন দিন পাইবেও না।”
“প্রাগৈতিহাসিক” গল্পে লেখক নাটকীয় পরিচয় ব্যবহার করেছেন। ভিখু পেহ্লাদের বাড়িতে আশ্রয় পেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় সে কামার্ত হয়ে পেহ্লাদের বউয়ের হাত চেপে ধরে নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
গল্পে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানিক
বন্দ্যোপাধ্যায় সফলতা লাভ করেছেন। তিনি চরিত্র অনুযায়ী বাস্তবানুগ ভাষা ব্যবহার করেছেন।
ভিখু,পাঁচী,পেহ্লাদের মতো নিন্ম শ্রেণী তথা অশিক্ষিত চরিত্রের জন্য তিনি আঞ্চলিক অমার্জিত
ভাষা ব্যবহার করেছেন। যেমন
ভিখু:
তরেই খুন করতে মন লইতাছে পেহ্লাদ ।
“প্রাগৈতিহাসিক” গল্পে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ভাষার মধ্যেও অলংকার ব্যবহার
করেছেন। তিনি প্রচলিত উপমা এ গল্পে ব্যবহার করেন নি। তিনি বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে যথাযথ
ভাব ও বর্ণনা উপযোগী করে উপমা ব্যবহার করেছেন। যেমন
অগ্নিবীণা কাব্যে বিদ্রোহী চেতনা এখানে
“ডান হাতটি তাহার (ভিখু) ভাল হইল না, গাছের মরা ডালের মত শুকাইয়া গিয়া অবশ ও অকর্মণ্য হইয়া পড়িল।”
পরিশেষ বলা যায় যে, বিষয়, চরিত্র,দৃষ্টিকোণ
এবং ভাষা প্রতিটি ক্ষেত্রে “প্রাগৈতিহাসিক” গল্পে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার শিল্পী মানসিকতার ছোঁয়া
লাগিয়েছেন। ফলে গল্পটি বাংলা সাহিত্যে একটি অন্যতম ছোট গল্প হিসেবে শিল্প মণ্ডিত হয়েছে।