অনুবাদ সাহিত্য; মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্যের ধারা।

 



অনুবাদ সাহিত্য; মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্যের ধারা। 

অনুবাদ সাহিত্যের ধারা; মধ্যযুগের বাংলা অনুবাদ সাহিত্য। 

কাল নিরবধি আর পৃথিবী বিশাল। কিন্তু নিরবধি কালে বিশেষ বিশেষ যুগে জীবনের রং আর রুপের পরিবর্তন ঘটে। পরিবর্তন আসে অনেক কিছুর। কখনো ধর্ম দর্শনের, কখনো কাব্য কবিতায়, কখনো বা ভাব জগতের। মানুষ তার এই পরিবর্তনশীল চিন্তা গবেষণা ও মন মানসিকতা চিহ্নিত করে রাখে কালের পৃষ্ঠায়। পরবর্তী যুগের মানুষ এর থেকেই সংগ্রহ করে রুপ ও রস। সুক্ষ বিচারের মানদণ্ডে বলা যায় নিয়ত পরিবর্তনশীলতার মধ্যেও মানুষের এমন কতগুলি ভাব আছে যা প্রত্যেক নতুন যুগে নতুন রং ও রুপের মধ্যে দিয়ে বারবার আত্মপ্রকাশ করে। মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্য ঠিক তেমন। সাহিত্যেরি একটি বিস্তৃত অঙ্গন জুড়ে অনুবাদ সাহিত্যের চর্চা করা হয়েছিল। যার ফলে মধ্যযুগের সাহিত্য পেয়েছে এক অনন্য মাত্রা। 

বিভিন্ন ভাষা থেকে মধ্যযুগে যেসব কাব্য অনূদিত হয়েছে তার সংখ্যা কম নয়। মধ্যযুগের অনুবাদের ধারাকে ভাষাগত দিক থেকে তিন ভাগে ভাগ করতে পারি—

 ক. সংস্কৃত ভাষা 

খ. আরবি, ফারসি ভাষা

গ. হিন্দি ভাষা থেকে ।

 

ক. সংস্কৃত ভাষা থেকে অনুবাদ : সংস্কৃত ভাষা থেকে মধ্যযুগে যেসব উচ্চাঙ্গের শিল্পকর্ম অনূদিত হয়েছে তার মধ্যে রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত উল্লেখযোগ্য।

রামায়ণ : পনের শতকের গোড়ার দিকে কৃত্তিবাস বাল্মীকি সংস্কৃত রামায়ণের বঙ্গানুবাদ করেন। এটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম অনুবাদ গ্রন্থ। রামায়ণের বাংলা অনুবাদসমূহের মধ্যে সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় অনুবাদক কৃত্তিবাস। পণ্ডিতদের মতে, সুলতান রুকনউদ্দিন বরবক শাহের রাজত্বকালে কৃত্তিবাস রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন (১৪৫৯-১৪৭৪)।

কৃত্তিবাসের রামায়ণ পাঁচালি কাব্যের আঙ্গিকে রচিত। বাল্মীকির রামায়ণের সারাংশ মাত্র অনুসরণ করে ভক্তের ভগবান, ক্ষত্রিয়বধূ সীতা হয়েছেন সর্বংসহা পতিপ্রাণগতা বাঙালি বধূ। লক্ষ্মণ হয়েছে বাঙালির উপযোগী করে এটি রচিত। রামায়ণে রাম বীর কিন্তু কৃত্তিবাসের হাতে রাম হয়েছের চৈতন্য পরবর্তী কালের শ্রেষ্ঠ রামায়ণ সাহিত্য হিসেবে অদ্ভুতাচার্যের ‘রামায়ণ কথা' বিশেষ গুরুত্ব ভ্রাতৃত্বের প্রতীক । সপ্তদশ শতকে অদ্ভুত আচার্য (নিত্যানন্দ আচার্য) রামায়ণের অনুবাদ করেন। বহন করে। এ ছাড়াও খণ্ডিত ও অখণ্ডিত উভয় মিলে আরও বেশ কয়েকজন রামায়ণ অনুবাদ করেছেন। এদের মধ্যে দ্বিজ, গঙ্গানারায়ণ, ঘনশ্যামদাস, ভবানীদাস, দ্বিজ লক্ষ্মণ, কৈলাস ব চন্দ্রাবতী, রঘুনাথ প্রমুখ অনুবাদক হিসেবে প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন ।

শেষ লেখায় রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুভাবনা এখানে

মহাভারত : মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মহাভারত একটি বিশিষ্ট স্থান জুড়ে আছে। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব, কৌরব ও পাণ্ডবদের যুদ্ধসংক্রান্ত নানা উপকাহিনীগুলোকে একত্রিত করে সংস্কৃত ভাষায় বিরাটাকায় মহাভারত রচনা করেন। র‍্যাসদেবের মহাভারত ছাড়া জৈমিনির মহাভারত আমাদের দেশে প্রসার লাভ করেছিল । অনুবাদকেরা জৈমিনির মহাভারতকে আদর্শ হিসেবে ধরে মহাভারতের অনুবাদ করেন। পঞ্চদশ শতক থেকে মহাভারতের অনুবাদ শুরু হলেও সপ্তদশ শতকে কাশিরাম দাসের অনুবাদের মাধ্যমে মহাভারত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মহাভারতের প্রথম অনুবাদক কবীন্দ্র পরমেশ্বর। তিনি আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সেনাপতি পরাগলের আদেশে ও পৃষ্ঠপোষকতায় মহাভারত অনুবাদ করেন। তাঁর এ মহাভারত পরাগলী মহাভারত নামে খ্যাত । পরাগল খাঁর পুত্র ছুটি খানের নির্দেশে শ্রীকরনন্দী জৈমিনি মহাভারতের উপর নির্ভর করে অশ্বমেধ অংশ নিয়ে মহাভারত রচনা করেন। কাব্যটি ছুটি খানের মহাভারত নামে পরিচিত। কাশীরাম দাসের পূর্বে নিত্যানন্দ ঘোষ মহাভারত অনুবাদ করেছেন কিন্তু এ অনুবাদটিতে তেমন কাব্যগুণ নেই। মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কায়স্থ বংশীয় কাশীরাম দাস। তিনি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন-এর সংস্কৃত মহাভারতের অনুসরণে মহাভারত রচনা করেন। তিনি মহাভারতের ভাবানুবাদ করেন। তাঁর কাব্যে ক্লাসিক্যাল গাম্ভীর্য আছে। গঙ্গারাম দাস নামে আরেকজন অনুবাদক ব্যাসদেবের মহাভারতের আদর্শরূপে মহাভারত অনুবাদ করেছেন। মহাভারত রচনার ধারা দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে সম্প্রসারিত ছিল। মহাভারতের অনুবাদকের সংখ্যা ৩০ জনের অধিক।

ভাগবত পুরাণ : মালাধর বসু বা গুণরাজ খান ভাগবত অবলম্বনে সুলতান রুকনুদ্দিন বরবক শাহের রাজত্বকালে রচনা করেন 'শ্রীকৃষ্ণবিজয়'। বৈষ্ণব ধর্মগ্রন্থ ভাগবতের এ অনুবাদটি বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের দ্বিতীয় গ্রন্থ ।

কাব্যটিতে শিল্পসৌন্দর্য অপেক্ষা আধ্যাত্মিকতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কাশীরাম দাসের অগ্রজ কৃষ্ণদাস ভাগবত অবলম্বনে 'শ্রীকৃষ্ণ বিলাস' ও 'গোবিন্দ বিজয়' নামে দুটি কাব্য রচনা করেন তাছাড়া ভাগবতের অনুসরণে কবি শেখর রচিত কাব্য ‘গোপাল বিজয়'। ভাগবত অবলম্বনে পরশুরাম চক্রবর্তী রচনা করেন ‘শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল' কাব্য ।

প্রমথ চৌধুরীর গদ্যরীতি দেখুন

খ. আরবি-ফারসি : বাংলার মুসলমান কবিরা ভারত ও পারস্যের সুফী কবিদের কাব্যের অনুবাদ করে যে ধারাটি গড়ে তুলেছেন তা রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান নামে পরিচিত। মধ্যযুগের অনুবাদ শাখা ভাবে ও ভাষায় বাংলা সাহিত্যের যে সমৃদ্ধি সাধন করেছে, রোমান্টিক প্রণয় উপাখ্যানগুলো এ অনুবাদের পর্যায়ভুক্ত। তবে এগুলো মূলত ভাবানুবাদ। আরবি-ফারসি ভাষায়

 

রচিত বিদেশি গল্পের অস্থিতে বাংলার রক্ত মাংসের সংযোজন করা হয়েছে। আরবি ফারসি ভাষা হতে যেসব কাব্য অনূদিত হয়েছে তা নিম্নরূপ-

ইউসুফ-জোলেখা : বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি শাহ মুহম্মদ সগীর গৌড়ের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের রাজত্বকালে (১৩৯৩-১৪০৯) 'ইউসুফ-জোলেখা' রচনা করেন । কাব্যটি ফারসি কবি ফেরদৌসের 'ইউসুফ ওয়া জুলায়খা' গ্রন্থের ভাবানুবাদ। কাহিনীর ভিত্তি সূরা ইউসুফ। কাব্যে কবির মৌলিকত্ব রয়েছে। বাংলার আবহে এ কাব্য রচিত। ফেরদৌসের মত সগীরের ইউসুফ-জোলেখাও ভাবুক-ভাবিনী । সগীর ব্যতীত ‘ইউসুফ-জোলেখা' কাব্যের রচয়িতা আব্দুল হাকিম, গরীবুল্লাহ্, গোলাম সফাতউল্লাহ্, সাদেক আলী ও ফকির মুহম্মদ ।

লায়লী মজনু : ফারসি কবি জামীর ‘লায়লী-মজনু' কাব্য অবলম্বনে দৌলত উজির বাহরাম খাঁ ‘লায়লী-মজনু' কাব্য রচনা করেন। কাব্যটি (১৫৬০-১৬৬৯) এর মধ্যে লেখা। কাব্য ও কবিত্বের সকল গুণে বাহরাম খান মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের কবিকুল শ্রেষ্ঠ ।

সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল : দোনাগাজী চৌধুরী, আলাওল, ইব্রাহিম ও মালে মহম্মদ আরব্য উপন্যাস অবলম্বনে সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল নামে প্রেমকাহিনী রচনা করেন । পরীরাজকন্যা বদিউজ্জামালের ছবি দেখে রাজপুত্র সয়ফুল তার প্রতি প্রেমাসক্ত হয়। বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে তাদের বিয়ে হয় । রূপকথাধর্মী অলৌকিক ঘটনা ও চরিত্রে কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। অন্যান্য অনুবাদ কাব্য : ইরানি কবি নেজামির হপ্তপয়কর ও ইস্কান্দারনামা গ্রন্থদ্বয়ের সরল অনুবাদ করেন আলাওল। ফারসি কবি শেখ য়ুসুফের ‘তুহফাতুনসার' অবলম্বনে আলাওল 'তোহফা' নামে ধর্মীয় নীতিকাব্য অনুবাদ করেন। ফারসি সাহিত্য থেকে কবি জৈনদ্দিন অনুবাদ করেন ‘রসুলবিজয়'। সৈয়দ সুলতান সালাবী বর্ণিত 'কিসাসুল আম্বিয়া' অবলম্বনে অনুবাদ করেন ‘নবী বংশ’ ।

গ. হিন্দি : পদ্মাবতী : আলাওলের 'পদ্মাবতী' হিন্দি ভাষা হতে বাংলায় অনূদিত কাব্যগুলোর মধ্যে সর্বৈব শ্রেষ্ঠ। মালিক মুহম্মদ জায়সীর ‘পদুমাবৎ' কাব্য থেকে ‘পদ্মাবতী' অনুবাদ করা হলেও কাব্যটিতে আলাওলের স্বকীয়তা, বিশেষত্ব ও পাণ্ডিত্য অনস্বীকার্য ।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য দেখুন

মধুমালতী : হিন্দিভাষী কবি মনরুত-এর 'মধুমালতী' কাব্য অবলম্বনে মুহম্মদ কবীর ‘মধুমালতী' কাব্য অনুবাদ করেন। কাব্যটি ১৫৮৮ সালে অনূদিত । এর কাহিনীর উৎস ভারতীয় উপাখ্যান । কাব্যটিতে প্রেমচিত্র উজ্জ্বল । রূপ ও প্রেমের বর্ণনায় কবির যে সংযমবোধ তা মধ্যযুগে দুর্লভ, কাব্যটিতে কবির নিজস্বতা স্পষ্ট। একই কাহিনী অবলম্বনে সৈয়দ হামজা, মুহম্মদ চুহর, শাকের মুহম্মদ, গোপীনাথ দাস প্রমুখ কাব্য রচনা করেন ।

সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী : হিন্দিভাষী কবি মিয়া সাধনের মৈনাসত' কাব্য অবলম্বনে দৌলত কাজী ‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী' রচনা করেন। কাব্যটির শেষ অংশটি অনুবাদ করেন আলাওল । কাব্যের কাহিনী পরিকল্পনায় কাজী দৌলতের অভিনবত্ব নেই, কিন্তু স্বাতন্ত্র্য রয়েছে।

মধ্যযুগের বাংলা অনুবাদ সাহিত্য বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ধর্মীয় পশ্চাৎপদতা থেকে মুক্ত করে মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি এনে সাহিত্যে মানুষের প্রাধান্য বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে । বাংলা সাহিত্যের আধুনিক ধারা সৃষ্টিতে ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্য ।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন