গদ্যশিল্পী মীর মশাররফ; গদ্যশিল্পী মীর মশাররফ হোসেন

 



প্রশ্নঃ- মীর মশাররফ হোসেনের গদ্যরীতি বা ভাষারীতির বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর?

গদ্যশিল্পী মীর মশাররফ; গদ্যশিল্পী মীর মশাররফ হোসেন; উনিশ শতকে গদ্যশিল্পী মীর মশাররফ;

    মীর মশাররফ হোসেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা গদ্য সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় প্রতিভা। সে প্রতিভার সূচনা দেখা যায় তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘রত্নাবতী’তে আর সর্বোত্তম বিকাশ ‘বিষাদ সিন্ধু’তে। সাহিত্যে প্রবল প্রতাপশালী বঙ্কিমের সম-সাময়িক যুগে জন্ম গ্রহণ করেও মীর মশাররফ গদ্য রচনায় আপন ভুবন সৃষ্টি করেছিলেন। আর তা বিষয়বস্তুর গাম্ভীর্যে বা করুণ রসের অভিসিঞ্চনে নয়, ভাষার সংগীত মধুরতার জন্য এবং তার বেগবান গতির জন্য। তাঁর গদ্য রচনা জন-গণ চিত্তকে আলোড়িত করেছে বিগত শতবর্ষ ধরে।

    মীর মশাররফ হোসেনের গদ্য রচনার পঠন-পাঠন তিন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গদ্য উপন্যাস কিংবা নাটকে তিনিই প্রথম সার্থক শিল্পী। দ্বিতীয়ত: তাঁর সমগ্র রচনাবলীতে তৎকালীন বঙ্গদেশের সমাজের বিভিন্ন দিকের চিত্র পাওয়া যায়। তৃতীয়ত: মশাররফের গদ্য রচনারীতি বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসে এক বলিষ্ঠ অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

মঙ্গলকাব্যের ধারা নোটটি দেখুন

    মীর মশাররফ হোসেনের সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত সাধুরীতিতে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘রত্নাবতী’তে সর্বত্রই সাধু ভাষার প্রয়োগ দেখা যায়। ‘রত্নাবতী’রভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তৎসম শব্দের প্রচুর ব্যবহার। যেমন- “গুজরাটি নগরের রাজপুত্রের সহিত সেই রাজ্যের মন্ত্রিপুত্রের অভেদ্য প্রণয় ছিল। ....... তাহারা বাল্যকালবধি যৌবনকাল পর্যন্ত একত্র ভোজন, একত্র শয়ন এবং এক সংগে ক্রীড়াদি করাতে প্রণয়ের বিশেষ আধিক্য জন্মিয়াছিল।”

    মীর মশাররফ হোসেনের গদ্য ফেনিলোচ্ছল ও বেগবান। ‘রত্নাবতী’তে ব্যবহৃত উপমাগুলো গতানুগতিক হলেও ভাষার ব্যবহারে বেগবান-

“চিত্ত বারণ ধৈর্যাঙ্কুশেও বারণ না মানিয়া সেই পদ্মিনী গ্রহণ করিতে প্রতিজ্ঞা সরোবরে ধাবিত হইতেছে।”

“দুঃখ জলধি চিন্তা বায়ুর প্রতিঘাতে স্ফীত হইয়া হৃদয়কে আঘাত করিতে লাগিল।”

    ঘটনার গতিরুদ্ধ করে ভাবনার সংযোজন মশাররফ হোসেনের গদ্য রচনার একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। এ কৌশল তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের কাছ থেকে লাভ করেছেন। বঙ্কিমের ভাষার মত মীর সাহেবের ‘বিষাদ সিন্ধু’ গ্রন্থের ভাষা সরল সাধু ভাষা। বঙ্কিমের উপন্যাসে সংস্কৃত শব্দের বাহুল্য লক্ষণীয়। যেমন- “চল তিলোত্তমাকে রাখিয়া অন্যত্র যাই। যথায় চাঞ্চল্য, চাতুরী, রসপ্রিয়া, রসিকা বিমলের পরিবর্তে গম্ভীরা অনুতাপিতা মলিনা বিধবা চোখে অঞ্চল দিয়া বসিয়া আছে।” আর ‘বিষাদ সিন্ধু’ গ্রন্থে সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়- “যেদিন এজিদের নয়ন জয়নাবের মুখ চন্দ্রিমার পরিমল সুধা পান করিয়াছে, সেইদিন এজিদ জয়নাবকে মনপ্রাণ সর্ম্পণ করিয়া জয়নাব রূপসাগরে আত্মবির্সজন করিয়াছে।” বঙ্কিমের ভাষা অনবদ্য গদ্য কবিতাধর্মী এবং ভাষায় রয়েছে সংগীত ধর্মীতা।

যেমন-

সাগর নাদে যেন মন্দীভূত হইতে লাগিল

সাগর বাসনা পৃথিবী সুন্দরী;

রমনা সুন্দরী ধ্বনিও সুন্দর

    বঙ্কিমের মত ‘বিষাদ সিন্ধু’র গদ্য ভাষার অন্তর্লীন সংগীত প্রবাহ গ্রন্থটিকে বহুলাংশে কাব্য সৌন্দর্য দান করেছে। যেমন- “চক্ষু নির্দিষ্ট সীমা মধ্যে মানব প্রকৃতি জীব জন্তুর নাম মাত্রই নাই, অতপ-তাপ নিবারোনোপযোগী কোন প্রকার বৃক্ষও নাই, কেবলই প্রান্তর- মহাপ্রান্তর।”

মধ্যযুগের রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান দেখুন

    ‘বিষাদ সিন্ধু’ গ্রন্থে গদ্য ভাষার ফেনিলোচ্ছল ও বেগবান রূপ লক্ষ্যণীয়। “হুতাশনের দহন আশা, চক্ষুর দর্শন আশা, গাভীর তৃণ ভক্ষণ আশা, ধনীর ধন বৃদ্ধির আশা, প্রেমিকের প্রেমের আশা, আশার যেন নিবৃত্তি নাই-ইতি নাই। যতই কার্য সিদ্ধি ততই দুরাশার শ্রীবৃদ্ধি।” অথবা “বিবি জয়নাব! মনে আছে সেই আপনার গৃহ নিকটস্থ রাজপথ? মনে করুন। যেদিন আমি সৈন্য সামন্ত লইয়া মৃগয়ায় যাইতেছিলাম, আপনি আমাকে দেখিয়া গবাক্ষ দ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন। কে না জানিল যে, দামেস্কের রাজকুমার মৃগয়ায় গমন করিতেছেন, শত সহ¯্র চক্ষু আমাকে দেখিতে ঔৎসুকের সহিত ব্যস্ত হইল, কেবল আপনার দুইটি চক্ষু তখনই ঘৃণা প্রকাশ করিয়া আড়ালে অর্ন্তধান হইল। .... কি কারণে দামেস্কের পাটরাণী হইতে আপনার অনিচ্ছা।”

    “এসলামের জয়” গ্রন্থে যুদ্ধ বর্ণনায় মীর সাহেবের দক্ষতা অসাধারণ। যেমন- “ খালেদ অসি চালনায় নিক্ষিপ্ত অস্ত্র-শস্ত্র সমুদয় ব্যর্থ করিতেছেন, শত্রু গণের অস্ত্রবল সম্পূর্ণরূপে অসিতে প্রতিঘাত হইতেছে। অসি জরাজীর্ণ হইল দেখিতে দেখিতে বীরবর মহামতি খালেদের হস্তস্থিত তরবারী ঝনঝন শব্দে ভাঙিয়া পড়িল। তখনই পৃষ্ঠরক্ষক রক্ষী দল দ্বিতীয় অসি যোগাইল। সে সময় রোমীয় সৈন্য প্রবল ঝাঞ্চাবাতে কদলী বৃক্ষ পতিত সদৃশ খালেদের তরবারী তেজে মৃত্তিকায় লুটাইয়া পড়িতে লাগিল।” বাংলা গদ্যের একটা অসাধারণ ঋজু ভঙ্গী চিত্র বর্ণনার উপযোগী শব্দ যোজনার ভাষা গতি মুখর হয়ে উঠেছে। বীররস ও যুদ্ধের ত্রস্ততর গতিবেগ অশ্বখুরের দাপটের সঙ্গে মিশে মীর সাহেবের গদ্য ভঙ্গিকে তড়িৎ-তরল ক্ষিপ্ততা ও স্পষ্টতা দান করেছেন। অসি চালানের মতই সুদক্ষ ভাষা শিল্পীর ন্যায় যথেচ্ছা ভাষা ব্যবহারে তিনি অদ্ভুত শক্তিময়তার পরিচয় দিয়েছেন।

    মশাররফ হোসেন সাহিত্যিক হিসেবে ছিলেন আবেগ প্রবণ। তদুপরি তার প্রাণ-প্রতিম স্ত্রীর মৃত্যুতে জীবন তাঁর কাছে মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে। তাই ‘বিবি কুলসুম’ গ্রন্থটিতে রয়েছে শোকাহত স্বামীর হৃদয়ের প্রেম ও স্নেহ নিংড়ানো নির্যাস। আর এ কারণেই তাঁর গদ্য ভাষা বেগবান। “বিবি কুলসুম আমার জীবনের জীবনী, নয়ন মন চিত্ত হরিণী, চিত্তাকর্ষিণী, আমার কানে মধুর ভাষিণী, সুহাসিনী, আমার সম্পূর্ণ ভালবাসার অধিকারীণী, সমভাবে সুখ-দুঃখ ভোগিনী।”

মধ্যযুগে অনুবাদ সাহিত্যের ধারা ক্লিক করুন

    মশাররফ হোসেন গদ্য বাক্য রচনায় বৈচিত্রের অনুসারী। ঘটনার যেখানে বেগ সঞ্চারের প্রয়োজন সেখানে পর পর সল্প দৈর্ঘ্যরে বাক্য যোজনা করা হয়েছে। বিশেষ করে প্রশ্নবোধক বাক্যের সহয়তায় একটি চিত্রকে জীবন্ত ও চলমান করার প্রবণতা বহুস্থানেই দৃষ্ট হয়। যেমন- “একি! প্রহরীগণ ছুটা ছুটি করে কেন? প্রহরীগণ উর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়াছে। পরস্পর দেখা যাইতেছে কিন্তু বড় সাবধানে-চুপে চুপে। ........ কেন?”

    কবিতার মত গদ্য রচনায় একটা ছন্দ বা গতি আছে এ গতি গদ্যকে কাব্যিক সুষমা দান করে। যেমন- “তুমি আমার একমাত্র পুত্র। এই অতুল বিভব, সুবিস্তৃত রাজ্য এবং অফুরন্ত সৈন্য সকলি তোমার। দামেস্কের রাজমুকুট অচিরেই তোমার শিরে শোভা পাইবে।” অথবা- “হয় দেখিবেন না হয় শুনিবেন, এজিদ বিষ পান করিয়া যেখানে শোক তাপের নাম নাই, প্রণয়ের হতাশা নাই, অভাব নাই এবং আশা নাই এমন নির্জন স্থানে এই পাপময় দেহ রাখিয়া সেই পবিত্র ধামে চলিয়া গিয়াছে।”

    ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ গ্রন্থখানি সরল সাধু ভাষায় লিখিত। এতে সমাজ সচেতন শিল্পীর জীবনধর্মী মনোভাব পরিস্ফুট। এ উপন্যাসে মীর সাহেব বেশ কিছু প্রবাদ বাক্য ব্যবহার করেছেন, যা তাঁর রচনার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে।

·         শত্রুর মুখ আর পাগলের জিহবা দুই ই সমান।

·         এক গাছের বাকল অন্য গাছে লাগে না।

    ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’র ভাষাও সহজ ও সাধু ভাষা। এ গ্রন্থে প্রবাদ বাক্য ব্যবহারের পাশাপাশি অনেক প্রচলিত আরবি ও ফার্সী শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর গদ্য অধিকতর শিল্পিত ও জীবন ধর্মী। যেমন- “অল্প বয়সে স্বামী দুনিয়া ছাড়া হলেন। কত লোকের চক্ষু পড়ল, পুড়ল। ... অবলা অসহায়ার জীবন যৌবন রক্ষার দিকে চক্ষু ঘুরল না, পড়ল না।”

    বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৭৩ সালে ‘বঙ্গদর্শন’এ মীর মশাররফের গদ্য সম্পর্কে মন্তব্য করেন “তাহার রচনার ন্যায় বিশুদ্ধ বাঙ্গালা অনেক হিন্দু লিখিতে পারিতেন না। হইার দৃষ্টান্ত আদরণীয়।” বস্তুত ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভাষার এমন সচ্ছতা, সমৃদ্ধি ও বিশুদ্ধতা আনায়ণ আর কোনো মুসলমান সাহিত্যিকের পক্ষে সম্ভব হয় নি। ব্যঞ্জনাময় প্রকাশ ভঙ্গীর কুশলতায়, গঠন কৌশলের নিপুণতায়, রচনারীতির গৌরবে, শিল্পবোধের প্রাধান্যে মশররফ হোসেন সমসাময়িক সাহিত্যিকদের মধ্যে অদ্বিতীয়।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন