মঙ্গলকাব্য ; মনসা মঙ্গলের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য কবির পরিচয় দাও।

 




প্রশ্নঃ মঙ্গলকাব্য বলতে কি বুঝ? মঙ্গলকাব্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য কি কি এবং মনসা মঙ্গলের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য কবির পরিচয় দাও।

 

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে বিশেষ এক শ্রেণীর ধর্ম বিষয়ক আখ্যানকাব্য মঙ্গলকাব্য নামে পরিচিত। খ্রীঃ পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ পর্যন্ত। পৌরানিক, লৌকিক ও উভয়ের সংমিম্রিত দেবদেবীর লালামাহাত্ম্য পূজা প্রচার ও ভক্ত কাহিনী অবলম্বনে এই শ্রেণীর সাম্প্রদায়িক ও প্রচারধর্মী সাহিত্য রচিত হয়। মঙ্গল শব্দটির আভিধানিক অর্থ কল্যাণ। যে কাব্যের কাহিনী শ্রবণ করলে সর্ববিধ অকল্যাণ নাশ হয় এবং পূর্ণাঙ্গ মঙ্গল লাভ ঘটে, তাহাকে মঙ্গল কাব্য বলে। মঙ্গল কাব্যের মঙ্গল শব্দটির সাথে শুভ ও কল্যাণের অর্থ সাদৃশ্য ছাড়াও এসব কাব্যের অনেকগুলি এবং মঙ্গলবারে পাঠ আরম্ভ হয়ে পরের মঙ্গলবারে সমাপ্ত হত বলে এ নামে অভিহিত হয়েছে। বিভিন্ন দেবদেবীর গুণগাণ মঙ্গলকাব্যগুলির উপজীব্য। তার মধ্যে স্ত্রী দেবতাদের প্রাধান্যই বেশী এবং মনসা ও চণ্ডিই প্রধান। পরম পূজ্য দেব-দেবীর পূজা প্রচারের ফলে কাহিনী কাব্যের নায়ক-নায়িকাদের যেমন দুঃসহ দূর্যোগ ও দূর্ভোগ থেকে নেমে এসেছিল অভাবিত সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি, ঠিক তেমনি এই সমস্ত কাব্যের পাঠক ও শ্রোতা সাধারণের জীবনে নেমে আসবে সর্বোচ্চ সমুন্নতি অশেষ কল্যাণ ও মহোত্তম মঙ্গল। মঙ্গল কাব্যগুলির উদ্ভব ও কাহিনী এর বিকাশের মূলে সে যুগে সচল ছিল এই ধরণের বিশিষ্টতম বিশ্বাস।

 

বাংলা সাহিত্যের নানা শ্রেণীর কাব্যে মঙ্গল কথাটির প্রয়োগ থাকলেও কেবল বাংলার লৌকিক দেবতাদের নিয়ে রচিত কাব্যই মঙ্গল কাব্য নামে অভিহিত হয়। প্রকৃতপক্ষে মঙ্গল কাব্যগুলিকে শ্রেণীগত দিক থেকে পৌরানিক ও লৌকিক এই দুই ভাবে ভাগ করা যায। পৌরানিক শ্রেণীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ গোরীমঙ্গল, ওবালীমঙ্গল, দূর্গামঙ্গল, অন্নদামঙ্গল ইত্যাদি। লৌকিক শ্রেণী হলঃ শিবমঙ্গল, মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, সারদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল, বায়ুমঙ্গল, শীতলামঙ্গল, সূর্যমঙ্গল ইত্যাদি।

 

বৈশিষ্ট্যঃ মঙ্গলকাব্যগুলির কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য সবিশ্বয়ে লক্ষ্য করার মত। মঙ্গলকাব্যের বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নে প্রদান করা হলঃ

১) গ্রন্থ উৎপত্তির কারণ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেব দেবীর স্বপ্নাদেশের বর্ণনা প্রতিটি মঙ্গল কাব্যেরই বিশেষ বৈশিষ্ট্য। স্বপ্নাদেশের বিস্তৃত বর্ণনার সঙ্গে অনিবার্যভাবে থাকে কবির আত্মপরিচয় প্রসঙ্গ এবং কাব্যের শুরুতে এবং শেষে থাকে হেয়ালী আকারে কাব্যের রচনাকাল সম্পর্কে সংকেত দান।

২) মঙ্গলকাব্যের কাহিনীতে নায়ক-নায়িকারা সবাই স্বর্গের সন্তান আপন আপন পূজা মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য সংশ্লিষ্ট কাব্যের দেব-দেবীরা তাদের সামান্য কারণে স্বর্গভ্রষ্ট করান এবং বিভিন্ন বিচিত্র ঘটনার পরম্পার মধ্য দিয়ে পূজা প্রচারের কাজ শেষে তাদের আবার স্বভূমি স্বর্গে ফেরত পাঠান।

৩) প্রতিটি মঙ্গলকাব্যের ‘‘দেবখন্ডে’’ থাকে গনেশাদি বন্দনা থেকে শুরু করে শিব-পার্বতীর সংসার আশ্রমে অনিবার্য কাহিনী বর্ণনা। তার মধ্যে দক্ষ প্রসঙ্গ ও তার পূর্বাপর ঘটনার বর্ণনা। কবিদের মধ্যে দেখা যায় উৎসাহের প্রাবল্য। ‘‘নর খন্ডে’’ বর্ণিত হয় কাব্যের মূল কাহিনী।

মধ্যযুগের রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান দেখুন

৪) সন্তানের জন্ম থেকে শুরু করে বিবাহাচার পর্যন্ত বিভিন্ন ধরণের সচল সংস্কার ও সামাজিক প্রথা পদ্ধতির বর্ণনা মঙ্গল কাব্যগুলির অন্যতম লক্ষনীয় বৈশিষ্ট্য। এ গুলির মধ্যে দিয়ে সম সাময়িক সমাজের সজীব ও সুন্দর বর্ণনা পাওয়া গেলেও এর মধ্যে নায়ক-নায়িকার নয়। কবির নিজস্ব সমাজের পরিচয়ই বিশেষ করে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

৫) নায়িকা নিভো সংসারের সুখ দুঃখের বার মাসের বিস্তারিত বর্ণনা বা ‘‘বারমাস্যা’’ মঙ্গলকাব্য মাত্রেরই বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এসব বর্ণনার মধ্যে পরিবর্তমান প্রাকৃতিক পরিবেশে ও পটভূমিতে সমসাময়িক জীবন চর্চার একটি সুন্দর চিত্র সুষ্পষ্ট হয়ে ওঠে।

৬) নায়ক-নায়িকার রূপ ও সাজ সজ্জার প্রাথমিক বিস্তারিত বর্ণনা প্রতিটি মঙ্গল কাব্যেরই অন্যতম লক্ষনীয় বৈশিষ্ট্য। গতানুগতিক গধবাধা বর্ণনা একঘেয়ে হয়ে উঠলেও সে যুগের নারীদের বিভিন্ন বিচিত্র পোশাক পরিচ্ছদ প্রসাধন ও অলংকারীদের পরিচয় একমাত্র এখান থেকেও পাওয়া সম্ভব।

৭) দাম্পত্য কলহ ও নারীদের প্রতিনিন্দার বিস্তারিত বর্ণনা প্রতিটি মঙ্গল কাব্যে সবিশেষ লক্ষনীয়। বিবাহ সভায় বরের বা অন্যত্র কোথাও কাব্যের নায়কের অপরূপ রূপ সৌন্দর্য্যে বিমোহিত নারীরা আপন আপন পতির সঙ্গে তুলনায় দুঃসহ্য দূর্ভোগের কথা তুলে বিচিত্রভাবে বিলাপ করতে থাকে। সংসারের সুখ দুঃখ ও অভাব অভিযোগের অংকিত চিত্রাবলী দাম্পত্য কলহের স্বরূপ ও সে যুগের দুঃসহ দারিদ্রের রূপকে সবিশেষ পরিস্ফুট করে তোলে।

মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্যের ধারা ক্লিক করুন

৮) সমুদ্রপথে ও বাণিজ্য বর্ণনা প্রায় মঙ্গল কাব্যেরই অন্যতম লক্ষনীয় বৈশিষ্ট্য। সমুদ্রপথে কালীদাহ, কমলে কামিনী বা সমুদ্র মরিচীকার বর্ণনার পরিচয়ের পাশাপাশি বৈদেশিক বাণিজ্য বিনিময় প্রথা, ব্যবসা বাণিজ্যের পথও পদ্ধতির প্রাসঙ্গিক পরিচয় এতে অনেকখানি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। তবে এ বর্ণনা সর্বত্র ব্যস্তবানুগ বলে মনে হয় না।

৯) মঙ্গল কাব্যের আর একটি লক্ষনীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিশ্বকর্মার শিল্পসৃষ্টি ও নগর বর্ণনা। পরিকল্পনা অনুযায়ী পুরী, নগর ও জাহাজ নির্মাণের মত দুঃসাধ্য কাজকর্মের পাশাপাশি সুক্ষ্মতম চিত্রকলা তথা নারীদের সমস্তরকম সুন্দর সাজসজ্জা ও কাছনী নির্মাণের দুরুহ দায়িত্ব ছিল রাজা কবিগণ বিশ্বকর্মার উপর। তাঁর সহায়ক হিসাবে হনুমানের উল্লেখ ও বিভিন্ন মঙ্গল কাব্যে লক্ষ্য করার মত।

১০) পূজা প্রচারকামী দেব-দেবীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী চরিত্রদের শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট দেব-দেবীর প্রসন্ন পদতলে নিঃশেষে নতি স্বীকার করানো মঙ্গল কাব্যের অন্যতম লক্ষনীয় বৈশিষ্ট্য। মনসা মঙ্গলের চাঁদ সদাগর চণ্ডী মঙ্গলের ধনপতি এবং ধর্মমঙ্গলের মহাদেব নাম এই প্রসঙ্গে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

১১) প্রহেলিকা ধাঁ ধাঁ এবং নারীর সতীত্ব পরীক্ষার প্রসঙ্গ প্রতিটি মঙ্গলকাব্যে অনিবার্যভাবে লক্ষনীয়। এছাড়াও এর মধ্যে পাওয়া যায় জ্যোতিষশাস্ত্রের বিভিন্নমূখী বিবরণ আহার, ভ্রমণ, সামাজিক, আচার আচরণ প্রভূতি প্রসঙ্গে বিচিত্র বর্ণনা।

১২) ভারতী ও বৃদ্ধার বেশে দেবী কর্তৃক নায়ক নায়িকাদের ছলনা ও শশ্মান বা শশ্মান বর্ণনা মঙ্গল কাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ দুটির মধ্য দিয়ে কাব্যের বীভৎসরতা পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা লক্ষনীয়।

১৩) অপরিহার্য পাক প্রণালী বর্ণনা এবং মানুষ পশু-পক্ষী, গাছপালা, ফুলফল, তীর্থস্থান, বাদ্যযন্ত্র প্রভূতির বিচিত্রতর তালিকা বর্ণনা প্রতিটি মঙ্গলকাব্যে সবিশেষ লক্ষনীয়।

১৪) বিপন্ন নায়ক কর্তৃক দেবীর ‘‘চৌতিশা’’ বর্ণনা মঙ্গল কাব্য মাত্রেরই সবিশেষ লক্ষনীয় বৈশিষ্ট্য। ক থেকে ক্ষ পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে কথোপকথোনগুলি দ্বারা দেব-দেবীর স্ফুতি ও তার সাহায্যে প্রার্থনাই সবের মূল লক্ষ্য।

১৫) নায়ক-নায়িকাদের স্বর্গারোহন ও মঙ্গলকাব্যের ফলশ্র“তি বর্ণনা বা অষ্টমালা মঙ্গল কাব্যের সমাপ্তিকে সুন্দর ও সুষ্পষ্ট করে তোলে। এখানে এতে বোঝা যায় যে কবির কাব্যের কাংক্ষিত লক্ষ্য পূরণ ঘটেছে।

 

মঙ্গল কাব্যের আরও অনেক বৈশিষ্ট্য থাকলেও এগুলি হচ্ছে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং এগুলির মধ্য দিয়ে মধ্যযুগের মঙ্গল কাব্যগুলি সম্পর্কে সুন্দর ও স্বচ্ছন্দ ধারণায় উপনীত হওয়া যায়।

শেষলেখা কাব্যের কবিগুরুর মৃত্যুচেতনা দেখুন

মনসা মঙ্গলের কবিগণ

মনসা মঙ্গলের কাহিনীর মানবজীবন বন্দনার প্রাচুর্য অসংখ্য কবিকে কাব্য রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেন কবির কথা উল্লেখ করেছেন। তবে সকলের পরিচয় পাওয়া যায় নি। নিম্নে মনসা মঙ্গল কাব্যের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন কবির পরিচয় দেওয়া হইলঃ

১) কানা হরি দত্তঃ মনসা মঙ্গলের আদি কবি হিসাবে কানা হরি দত্তকে মনে করা হয়। পঞ্চদশ শতকের শেষ বা সেন কবি বিজয়গুপ্ত আদি কবি হিসাবে হরিদত্তের কথা উল্লেখ করে বলেছেন।

‘‘মূর্খে রচিল গীত না জানে বৃত্তান্ত

প্রথমে রচিত গীত কানা হরিদত্ত।’’

কানা হরিদত্ত সম্পর্কে বিজয়গুপ্তের এই অনুদার মন্তব্য সত্য নয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। তার কাব্যে যেটুকু অংশ পাওয়া গেছে তা থেকে বোঝা যায় তিনি যথেষ্ট কবি প্রতিমন অধিকারী ছিলেন। চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল বলে অনুমান করা হয়।

 

২) নারায়ন দেবঃ

হরি দত্তের পর মনসামঙ্গলের অন্যান্য শ্রেষ্ঠকবি নারায়ন দেব। কবির কাব্য বাংলা ও আসামে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহাকুমারয় কবির জন্মস্থান। এই কবির পিতা মাতা নরসিংহদেব আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে নারায়ন দবে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে আবির্ভাব হয়েছিলেন। নারায়নদেবের কাব্যের নাম ‘‘পদ্মাপূরান’’। কাব্যটি তিন খন্ডে বিভক্ত। প্রথম খন্ডে কবির আত্মপরিচয় ও দেব বন্দনা, দ্বিতীয় খন্ডে পৌরানিক কাহিনী ও তৃতীয় খন্ডে চাঁদ সদাগরের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। নারায়ন দেবের পদ্মাপুরান সম্পর্কে ডঃ আহম শরীফ মন্তব্য করেছেন, ‘‘করুন রসের আধিক্য এবং ব্যঙ্গরসের বিষয় এ কাব্য মুখপাঠ্য করেছে। আর জনপ্রিয়তাই যদি শ্রেষ্ঠত্বের পরিমাপক হয় তাহলে নারায়ন দেবকে একজন শ্রেষ্ঠ কবির সম্মান দিতেই হবে।’’ এই কাব্যের পৌরানিক অংশে কবির পান্ডিত্যের পরিচয় দেখা যায়। করুন রসের বর্ণনায় নারায়ন দেবের সমকক্ষ আর কেউ নেই। শুধু তাই নয় সুখ, দুঃখ, আনন্দ বেদনার আর্থপরতা ও ঔদার্য সব কিছু মিলিয়ে বর্ণনায় নারায়ন দেবের সমকক্ষ এ যুগে আর কাউকে পাওয়া যায় না।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন