বিদ্যাসাগর মূলত একজন সমাজ সংস্কারক ।

 




সমাজ সংস্কারক বিদ্যাসাগর, বাংলা সংস্কার আন্দোলনে বিদ্যাসাগর, ঈশ্বরচন্দ্র 

বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার; সমাজ সংস্কারক হিসেবে বিদ্যাসাগর।


ঊনিশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব-দরদী বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রথম সার্থক শিল্পী হিসেবে সর্বজন পরিচিত। তিনি প্রধানত সমাজ সেবার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে লেখনী ধারণ করেছিলেন। সেজন্য মৌলিক রচনার পরিবর্তে অনুবাদ বা প্রতিবাদমূলক রচনার প্রতি তার প্রবণতা ছিল বেশি। আর সে সময় তার সম্মুখে এমন কোন বৃহৎ আর্দশ ছিল না- যার প্রেক্ষিতে তিনি সমশ্রেণীর সাহিত্য রচনা করেন। বরং কুসংস্কারপূর্ণ বাঙালী সমাজে মহৎ জীবনাদার্শ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাতেই তিনি অনুবাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অর্থ্যাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজ সংস্কার ও সমাজ পূর্ণগঠনে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা মূলত সমাজ বিপ্লবীর ভূমিকা। আর সমাজ বিপ্লবের সাথে সাথে বাংলা সাহিত্য তাঁর হাতে সমৃদ্ধ হয়েছে।

 

বাঙালী সমাজ সংস্কারের প্রয়োজনে বিদ্যাসাগর কিছু মৌলিক সাহিত্য রচনা করেন। ‘সর্বশুভকরী’ পত্রিকায় বিদ্যাসাগরের প্রকাশিত প্রবন্ধের নাম ‘বাল্য বিবাহের দোষ’। এত তিনি বিধবা দুঃখ দুর্দশা সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে বলেছেন-“বিধবাদের জীবন কেবল দুঃখের ভার। এবং এই বিচিত্র সংসার তাহার পক্ষে জনশুণ্য অরণ্যকার। পতির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তার সমস্ত সুখ সাঙ্গ হইয়া যায়। যে কঠোর ব্রহ্মার্য ব্রতাচরণ পরিণত শরীর দ্বারাও নির্বাহ করণ দুষ্কর হয়, সেই দুশ্চর ব্রতে কোমলাঙ্গী বালিকাকে বাল্যবধি ব্রতী হইতে হইলে তাহার সেই দুঃখ দগ্ধ জীবন যে কত দুঃখেতে যাপিত হয়, বর্ণনার দ্বারা তাহার কি জানাইব।”- এ বেদনাবোধ থেকে পরবর্তীকালে তিনি বিধবা বিবাহ বৈধীকরণ এবং সমাজিক স্বীকৃতির জন্য সর্বস্ব চেষ্টা করেছিলেন।

 

সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যেই বিদ্যাসাগর বিধবা ‘বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ নামে একটি পুস্তিকা স্বনামে লেখেন। বহুকাল প্রচলিত দেশাচার ও সমাজ সংস্কারের অন্যথা করেছিলেন বলে বহুজন মূঢ়ের মত তার বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন। তবুও তিনি বলেছেন-“বিধবা বিবাহের প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম, জন্মে ইহার অপেক্ষা অধিক আর কোন সৎকর্ম করিতে পারিব তাহার সম্ভবনা নাই, এ বিষয়ের জন্য সর্বশান্ত হইয়াছি এবং আবশ্যক হইলেও প্রাণান্ত স্বীকারেও....

নানা শাস্ত্রে পুঁথি পত্র ঘেঁটে বিদ্যাসাগর বিধবা বিহবাহের শাস্ত্রীয় প্রমাণ খুঁজে পেলেন। তিনি মনে করেছিলেন শাস্ত্রে আছে প্রমাণ করতে পারলেই যুক্তিবাদী ও শাস্ত্র আচারী বাঙালী সমাজ বিধবা বিবাহের বৈধতা স্বীকার করে নেবে। তাই তিনি ১৮৫৫ সালে ‘বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব নামে’ দ্বিতীয় পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এতেও তিনি প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হন। অতপর ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভায় আইন পাশ করার জন্য বিখ্যাত ব্যক্তিরা আবেদন করলেন। রায় কান্তদের বাহাদুরের নেতৃত্বে পঞ্চাশ হাজার ব্যক্তির স্বাক্ষর যুক্ত প্রতিবাদ পত্রও ব্যবস্থাপক সভার প্রেরিত হয়েছিল, কিন্তু সেই আইন প্রণেতারা তা গ্রাহ্য করেন নি। বিদ্যাসাগরের পক্ষে বহু গণ্য মান্য ব্যক্তি পণ্ডিত, বিচারপতি, অধ্যাপক, ডাক্তার, ইনঞ্জিয়ার, সমাজপতি, ভূস্বামী সম্প্রদায় এ আবেদন পত্রে সানন্দে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন এবং গ্রান্ট সাহেব নিজেও তৎপর হয়েছিলেন বলে, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিধবার পূর্ণবিবাহ আইন স্বীকৃত হলো এবং এ বিবাহ বিধবার গর্ভজাত সন্তান জনকের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী বলেও গৃহীত হলো, কিন্তু পূর্ণবিবাহরে পর বিধবা পূর্ব স্বামীর সম্পত্তির অধিকার হারাল। কিন্তু আইন পাশ করেই বিদ্যাসাগর ক্ষান্ত হলেন না, যথার্থ বিধবা বিবাহের উদ্যেগ গ্রহণ করলেন।

শেষলেখা কাব্যে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচেতনা এখানে

বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের শাস্ত্রীয়তা প্রমাণ করতে চেয়েছেন, যুক্তির দ্বারা তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বিধবা বিবাহ প্রচলিত না হলে সমাজে ব্যভিচার দোষ, ভ্রƒণ হত্যা পাপ বাড়বে, গোপনে অনুষ্ঠিত এ সমস্ত মহাপাপ থেকে বিধবাদের ও সমাজকে বাঁচাতে হলে বিধবা বিবাহের আশুপ্রয়োজনীয়তা তিনি প্রমাণ করেছিলেন।

এরপর তিনি সামাজিক কুসংস্কারের দ্বিতীয় উপাদান বহু বিবাহ প্রথাকে আক্রমণ করে দুখানি পুস্তিকা রচনা করেন। এ পুস্তকদ্বয়ে তিনি শাস্ত্র মন্থন করে বহু বিবাহের বিরুদ্ধে অকাট্য যুক্তি প্রয়োগ করেন এবং অভিসন্ধি পরায়ণ বহুবিবাহ সমর্থকদের নষ্টামিও ধরিয়ে দেন। শাস্ত্র ছেড়ে দিলেও তিনি সমাজ সংস্কারের দৃষ্টিকোণ থেকে বহুবিবাহ উচ্ছেদ চেয়েছিলেন। পুরুষ জাতির পীড়নে ও সামাজিক কুপ্রথার দোষে বহু বিবাহের স্বীকার স্ত্রী-জাতির দুঃখ দুর্দশা দূর করবার জন্য তিনি প্রথম পুস্তিকায় বহু বিবাহ সমর্থনকারীদের যুক্তশাস্ত্র বিচক্ষণের সাহায্যে খ-ন করেন। তিনি দেখান যে, শাস্ত্রে যথেচ্ছাক্রমে বহুবিবাহের সমর্থন নেই। বহু বিবাহ আইনত নিষিদ্ধ হলে এমন কিছু মহাভারত নিষিদ্ধ হবে না এবং কুলীন ব্রাহ্মণদের জাতি লোপও হবে না, সমাজ ধর্মেরও কোনো ক্ষতি হবে না।

বিদ্যাসাগর শুধু বাঙালি সমাজকেই সংস্কার করেন নি, বাংলা সাহিত্যকেও সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলা গদ্যের শৈশবকে কৈশোরত্ব প্রদান করা তাঁর কৃতিত্ব। বিদ্যাসাগর পূর্ববর্তী ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতি রচনায় রামমোহন গদ্য, পণ্ডিত মুন্সীদের গদ্য ব্যবহারের উপযোগী হওয়া সত্ত্বেও যতি চিহ্নের সল্পতা, বাক্যের ভারসম্য হীনতা ও সংযোজক অব্যয়ের সাহায্যে বিরুদ্ধবারের একাধিক বাক্যের সংযোজক গদ্যরীতিকে রসহীন করে তুলেছিল। আর সে রসহীন ও শ্রীছন্দহীন গদ্য বিদ্যাসাগরের হাতে জড়তা ও দুবোর্ধ্যতা থেকে মুক্তি লাভ করে এবং তাঁর হাতে বাংলা গদ্য সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করে। আর পরবর্তীকালে এ বাংলা গদ্যই বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের হাতে যৌবন পূর্ণ পরিণতি লাভ করেছে।

প্রমথ চৌধুরীর গদ্যরীতি প্রবেশ করুন

ক. তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ গ্রন্থ থেকেই তিনি বাংলা গদ্য শরীরে লাবণ্য ও লালিত্য সঞ্চার করতে থাকেন। গদ্য ভাষারও যে একটা বিশেষ রচনা পদ্ধতি, স্পন্দন, ছন্দস্রোত, যতি এবং সর্বোপরি গদ্যেও যে বিশেষ ব্যক্তি মনের প্রতিফলন হতে পারে অর্থ্যাৎ যাকে বলা হয় স্টাইল এ সমস্ত বৈশিষ্ট্যের সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে এ গ্রন্থে।

        খ. শকুন্তলার গদ্যে প্রাগঢ়তা, সৌষ্ঠব, সাবলীলতা ও প্রাঞ্জলতা আছে। এতে তৎসম শব্দের প্রাচুর্য থাকলেও কথোপকথনের কথ্য ভাষার সঙ্গে সাধু ভাষার চমৎকার সম্বনয় সাধিত হয়েছে। যেমন- “কতিপয় পদ গমন করিয়া শকুন্তলার গতি ভঙ্গ হইল। শকুন্তলা, আশার অঞ্চল বাঁধিয়া কে টানিতেছে এই বলিয়া মুখ ফিরাইলেন।”

        গ. বিদ্যাসাগরে চরিতে সাধু রীতি কত অনাড়ম্বর ও স্বাছন্দ হয়ে এসেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাক্য গুলো সংক্ষিপ্ত, ছেদ ও যতির দ্রুত আর্বতিত যেমন- “আজ আমি এখনও পর্যন্ত কিছু খাই নাই।”

        ঘ. বেনামী রচনা গুলিতে ভাষার মূর কাটামো সাধুরীতি ও বাচনভঙ্গি পুরোপুরি সংলাপধর্মী।

ঙ. সীতার বনবাসে ক্লাসিকধর্মী সংস্কৃতানুসারী ভাষার চরম প্রকাশ ঘটেছে। এতে তিনি সংস্কৃত শব্দের বাহুল্য বজায় রেখেও শুধু অনুপ্রাস, উপমা, রূপক, ইডিয়ম প্রয়োগের দ্বারা আখ্যানাংশের রসমূর্তি রচনা করেছেন। যেমন- “এই সেই জনস্তান মধ্যবর্তী প্রস্রবন গিরি! এই গিরির শিখর দেশ আকাশ পথে সতত সঞ্চারমান জলধর পটল সংযোগে নিরন্তন নিবিড় নীলিমায় অলংকৃত। ” এতে যুক্ত ও যুগ্ম ব্যঞ্জনের প্রয়োগ ধীর নয়, ধ্বনি ও শ্বাস বায়ুর অতিবিলম্বিত গ্রহণ বর্জনে রাজকীয় ঐশ্বর্য চোখে পড়ে।

                                     বিদ্যাসাগর মূলতঃ মানব প্রেমিক।‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’-এ বাণী তাঁর মুখেই সহজে সাজে। মানব মুক্তির ক্ষেত্রে তিনি যেখানে যখনই কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন তখনই তাঁর বিরুদ্ধে তেড়ে গিয়েছেন প্রচন্ড পরাক্রমে। সমাজের সচল সমস্যা সমূহের যেমন-বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহের প্রচলন,বিধবা বিবাহের অপ্রচলন প্রভৃতির স্বরূপ তিনি সুগভীরভাবে উপলব্ধিতে সক্ষম হন এবং শাস্ত্রাচার শানিত দেশে শাস্ত্র সিন্ধু মন্থনে সমর্থক সুসঙ্গত শ্লোক সমূহের দ্বারাই তাদের রহিতে বা প্রচলিত করতে চান। আর সেই সমস্ত কাজে রচনাই হয়ে ওঠে তাঁর প্রধান অবলম্বন। সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় যুদ্ধে রচনারূপ হাতিয়ার নিয়েই তাঁকে একান্তে এগিয়ে যেতে হয়। আর এভাবেই সমাজ সংস্কারক বিদ্যাসাগর অন্য অর্থে হয়ে ওঠেন মানব প্রেমিক সাহিত্যস্রষ্টা বিদ্যাসাগর।

 

পরিশেষে বলা যায়, বিদ্যাসাগর মূলত সংস্কারক ছিলেন। বাঙালী সমাজ ও বাংলা সাহিত্য দুই-ই তাঁর হাতে সমৃদ্ধ হয়েছে। আর এ জন্যে বাংলা গদ্য সৃষ্টির ভিত্তি রচনায় এবং সমাজ সংস্কারে বিদ্যাসাগরের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন