প্রশ্নঃ- ইন্দো-ইউরোপীয় শাখার বর্ণনা দাও।/ ইন্দো-ইউরোপীয় শাখা থেকে বাংলার ভাষার উদ্ভব আলোচনা কর।/ শতম/কেন্তুম শাখার পরিচয় দাও।
বিশ্ব
প্রকৃতি রাজ্যে মানুষের স্বাতন্ত্র্যের অভিজ্ঞানটি হল মন। বির্বতনের ধারায় প্রথমে জড়ের
বিকাশ, জড়ের পরে প্রাণ, প্রাণের পরে মনের। এই মনের বিকাশ মানেই মানুষের জন্ম। যে মানুষের
মন অনন্যসুলভ সেই মনের ত্রিধা বৃত্তি-চিন্তা, সংকল্প, অনুভব। আর তা প্রকাশের অন্যতম
মাধ্যম ভাষা। ভাষা হল মানুষের এমন এক অভিজ্ঞান যা অন্য প্রাণী থেকে তাকে স্বাতন্ত্র্য
দান করেছে। ভাষার ইতিহাস আলোচনা করে ভাষাতাত্ত্বিকগণ পৃথিবীর সমস্ত ভাষাকে কতগলো গোষ্ঠীতে
ভাগ করেছেন। এ গোষ্ঠীভুক্ত করার সময় তাঁরা একটা মূলসূত্র অনুসরণ করেছেন। পৃথিবীর প্রায়
চার হাজার ভাষাকে সেই সূত্র মতে বিচার বিশ্লেষণ করে ১২ টি বংশে বা গোষ্ঠীতে ভাগ করা
হয়েছে। ইন্দো-ইউরোপীয় তাদরে মধ্যে একটি অন্যতম গোষ্ঠী।
ইন্দো-ইউরোপীয়:
ইন্দো-ইউরোপীয় শাখাটির জন্ম জেসাসের জন্মের আগে এবং তা আজ পর্যন্ত এ বংশের ভাষা গৃলো
পৃথিবীতে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। এ গোষ্ঠীর নাম ইন্দো-ইউরোপীয় হওয়ার মূল কারণ হল,
বিশেষ একটি ভাষা বংশ যে ভৌগোলিক এলাকায় বিস্তৃত তার দুই দুরতম প্রান্তের নাম সমাস করে
সাধারণত নাম করা হয় বংশটির। এ বংশের পূর্ব প্রান্তে ভারত ও পশ্চিম প্রান্তে ইউরোপ তাই
এর নাম ইন্দো-ইউরোপীয়।
ইন্দো-ইউরোপীয়
ভাষা বংশটিকে দুটি উপবংশে বা শাখায় ভাগ করা হয়েছে। ক) কেন্তুম (Centum) খ) শতম (Satam)। এই
বিভাগের মূল কারণ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার পুরঃকণ্ঠ স্পৃষ্টধ্বনির পরবর্তী রূপান্তর।
ক) কেন্তুমঃ- যে ভাষাগুলো
পরবর্তীকালে মূল ভাষার উক্ত ধ্বনি পশ্চ্যাৎ কণ্ঠ বা স্নিগ্ধ তালব্য ধ্বনি হয়ে গেছে
সেগুলোকে কেন্তুম গুচ্ছের অন্তভুক্ত করা হয়েছে। এই গুচ্ছে পড়ে...
১. গ্রিক/ হেল্লেনিকঃ- যদিও বর্তমানে গ্রীক ভাষীদের
সংখ্যা কম। তবুও নানা কারণে এ গোত্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রীক ইতিহাস থেকে জানা
যায় যে, দুই হাজার খ্রিষ্টপূর্বে গ্রীস অনার্য জাতি দ্বারা অধ্যুষিত ছিল। প্রাচীন গ্রীক
ভাষা সর্ম্পকে তথ্য পাওয়া যায় সপ্তম শতকের রচিত নিদর্শন থেকে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা
যায় যে, প্রচলিত ভাষা দু’ভাগে বিভক্ত ছিল-
ক. পশ্চিমাঞ্চলীয়
খ. পূর্বাঞ্চলীয়।
২. কেলটীয়ঃ- ইতালির সাথে নানা বিষয়ে সাদৃশ্য আছে
কেলটীয়র। খ্রিষ্টপূর্বকালে কেলটীয়র নিদর্শন পাওয়া না। কেলটীয়রা সম্ভবত মধ্য ইউরোপের
অদিবাসী ছিল। পরবর্তীকালে তাঁরা ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড এ ছড়িয়ে পড়ে। কেলটীয়
গোত্রের দুটি ভাগ। ক) প-কেল্ট খ) ক-কেল্ট ।
৩. ইতালীয়:- খিষ্ট্রপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রতে ইতালীয়
ভাষাগোত্র অন্য কোথাও থেকে আসে ইতালীয় উপদ্বীপে। তবে খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দের আগে ইতালির
ভাষার পরিস্থিতি সর্ম্পকে কিছু জানা যায় নি। ইতালিয় ভাষার নিদর্শন পাওয়া গেছে খ্রিষ্টপূর্ব
সপ্তম শতকে। ইতালিয় গোত্রটির তিনটি শাখা আছে। ক) লাতিন-ফলিস্কান খ) অস্কো-উমব্রয়ী ও
গ) সবেল্লীয়।
৪. জার্মানীয়:- এ গোত্রের অন্য নাম টিউটনিক। জার্মানীয়
ভাষার আদি সাহিত্য নিদর্শন পাওয়া গেছে পূর্ব-জার্মানীয় বা জথিক-এ। ধর্মযাজক উলফিলা
জথিকে অনুবাদ করেছিলেন। বাইবেলে তার অংশ বিশেষ পাওয়া গেছে। এ গোত্রের ভাষাগুলোকে ভৌগোলিক
এলাকা অনুসারে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ক) পূর্ব জর্মনীয় খ) উত্তর জর্মনীয় গ) পশ্চিম
জর্মনীয়।
৫. বোখারীয়:- উনিশ শতকের শেষাংশে উপরের ভাষাগুলোকেই
মনে করা হতো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের সদস্য বলে। তবে এ শতকে শুরুতে চীনীয় তুর্কিস্থানে
আবিষ্কৃত হয় একটি মৃতভাষা। এটি সুস্পষ্টভাবে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা। এটি পাওয়া যায় ৬ষ্ঠ
থেকে ৮ম শতকের মধ্যে লিপিবদ্ধ কিছু চিকিৎসা শাস্ত্র ও বৌদ্ধ ধর্মীয় রচনায়। এর দুটি
উপভাষা ছিল। ক) অ্যাগনীয় বা পূর্ব তোখারীয় খ) কুচিয়ান বা পশ্চিম তোখারীয়। তোখারীয় ভাষীদের
সর্ম্পকে আজ পর্যন্ত কিছু জানা যায় নি।
খ. শতম:- যে ভাষাগুলোতে উক্ত মূলভাষার ধ্বনি পরবর্তীকালে শিস্ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়ে গেছে, সে ভাষাগুলোকে শতম গুচ্ছে ধরা হয়। এই গুচ্ছে পড়ে..
১. ইন্দো-ইরানীয়:- এ শাখাটিকে আগে আর্য ও ইন্দো
আর্য বলা হতো। এখন বলা হয় ইন্দো ইরানীয় বা ইন্দো ইরানি। সম্ভবত তিন হাজার বছর আগে এ
শাখাটি ভারত বর্ষে ও ইরানে এর ভাষাভাষীদের
দেশান্তরের ফলে উপনীত হয়। এ শাখাটির ভারতীয় উপশাখাটি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কেননা
এর প্রাচীন নির্দশন পাওয়া গেছে বেশি ইরানে। ইরানি যে উপশাখার যে নিদর্শন পাওয়া গেছে
তা অতটা প্রাচীন নয় পরিমাণেও কম।
২. আলবেনীয়:- আলবেনীয়র আদি ইতিহাস এখনো জানা সম্ভব
হয় নি। এর যে প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া গেছে তা পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে অনুবাদিত খ্রিষ্ঠীয়
রচনা। তবে এর বেশি নিদর্শন পাওয়া গেছে সতের শতকের লোক সংগীতে। এর দুটি উপশাখা আছে উত্তরে
‘গেগ’ আর দক্ষিণে ‘টোস্ক’
৩. আরমেনীয়:- দক্ষিণ ককেসাস ও পশ্চিম তুরস্কে প্রচলিত
আরমেনীয় ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া গেছে মাত্র ৫ম শতাব্দীতে। এর কয়েক শতক আগে আরমেনীয়রা
বসতি স্থাপন করে আরমেনিয়ায়। এ ভাষার প্রাপ্ত নিদর্শন গুলো খ্রিষ্ঠীয়ধর্মীয় রচনার অনুবাদ।
আধুনিক আরমেনীয় ভাষার শাখা দুটি - পূর্ব শাখা সোভিয়াত ইউনিয়ন ও ইরানে এবং পশ্চিম শাখা
তুরস্কে প্রচলিত।
৪. বালটো-স্লাভীয়ঃ- এর শাখার নামটি নির্দেশ, করে
যে এর দুটি প্রধান ভাগ একটি বালটীয়, অন্যটি স্লাভীয়, অনেকের মতে এ দুটি সুস্পষ্ট পৃথক
দুটি শাখা এদের সাদৃশ্যের মূলে রয়েছে দীর্ঘকালব্যাপী পারস্পারিক প্রভাব।
যাহোক ইন্দো ইরানীয়
শাখাটি দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। একটি যায় ইরানে অপরটি আসে ভারতীয় উপমহাদেশে তথা ভারতবর্ষে।
আমাদের আলোচ্য বিষয় এই দ্বিতীয় শাখাটি অর্থ্যাৎ ভারতীয় শাখা। ভাষাতাত্ত্বিকভাবে প্রাপ্ত
নিদর্শন অনুসারে এ দুটি শাখার মধ্যে ভারতীয় শাখাটি প্রাচীনতর। ভারতীয় শাখার মধ্যে আদি
নিদর্শন পাওয়া যায় ঋগে¦দ-এ। খ্রিপু ২০০০ থেকে খ্রিপূ ৫০০
অব্দের মধ্যে ঋগ্বেদ এর শ্লোক গুলো রচিত হয়। ভাষাবিদরা বেদ এর ধ্বনি, রূপ, অর্থ চমৎকারভাবে
ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন এর ফলেই বিধিবদ্ধ হয় একটি সুশৃঙ্খল মান ভাষা যার নাম সংস্কৃত।
জেসাসের জন্মে আগে ভারতীয় আর্যভাষার তিনটি স্তর পাওয়া যায়। ক. বৈদিক সংস্কৃত খ. ধ্রুপদী
সংস্কৃত গ. প্রাকৃত সংস্কৃত। বৈদিক ও ধ্রুপদী সংস্কৃতকে বলা হয় প্রাচীন ভারতীয় আর্য
ভাষা এবং প্রাকৃত সংস্কৃতকে বলা মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা। মধ্য আর্য ভাষার শেষ স্তদর
অপভ্রংশ-অবহট্ঠ। তবে কতগুলো প্রাকৃত প্রচলিত ছিল তা জানা যায় নি। কেউ কেউ ৩৮টি প্রাকৃতের
কথা বলেছেন। তবে এগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে- মহারাষ্ট্রী, শৌরসেনী, মাগধী, অর্ধমাগধী
ও পৈশাচী। বিভিন্ন প্রকৃতের অংশ থেকে উদ্ভুত হয় আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলো। শৌরসেনী থেকে
হিন্দু, পাঞ্জাবী, গুজরাটি প্রভৃতি মাগধী থেকে বাঙলা, বিহারী, আসামী, উড়িয়া অর্ধমাগধী
থেকে প্রাচ্য হিন্দি। মহারাষ্ট্রী থেকে মারাঠি ও সিংহলি এবং পৈচাশি থেকে পশাই, কাফির
প্রভৃতি।
তবে বাঙালা ভাষার উৎপত্তি সর্ম্পকে পণ্ডিতদের
মতনৈক্য রয়েছে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে মাগধী অপভ্রংশ
থেকে। অন্যদিকে ড. মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ মনে করেন গৌড়ী প্রকৃত নামে একটি রূপ ছিল এবং
সেই গৌড়ীয় প্রাকৃতের অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে। এজন্য বাংলা ভাষাকে এক সময়ে
গৌড়ীয় ভাষা বলা হতো। নিন্মে একটি চিত্রের মাধ্যমে ইনেআ-ইউরোপীয় থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভবের
বির্বতনের রূপ উপস্থাপিত হল।