অগ্নিবীণা কাব্য অবলম্বনে নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা।।

 




অগ্নিবীণা কাব্য অবলম্বনে নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার পরিচয় দাও।


নজরুল বিদ্রোহী কবি পরিচয় দাও।

বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যাকাশে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। কাজী নজরুল ইসলাম শুধু বিদ্রোহের কবিই নন, বাংলা সাহিত্য তথা বাংলাদেশের জাতীয় কবি। প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর কালে  ভারত বর্ষে এই প্রতিভাধর মহজ্ঞানী তাপস পুরুষের জন্ম। যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশ ঘটে অভাব অনটন, মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন। ভারতবর্ষে এই পরিবর্তনের জোয়ার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নতুন জোয়ার এনে দেয়। কাজী নজরুল ইসলাম দ্বীপ্ত কণ্ঠে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার উদাত্ত আহবান জানান। সকল প্রকার অন্যায় অত্যাচার শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এ বিদ্রোহের সুর প্রধানত ধ্বনিত হয়েছে তার অগ্নিবীনা কাব্যে।        

          বিদ্রোহ এবং আরো এগারটি কবিতা নিয়ে কাব্যটি ১৩২৯ বঙ্গাব্দে কার্তিক মাসে নজরুলের প্রথম কাব্য গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়। ইতিপূর্বে এক বছরের মধ্যে কবি হিসেবে নজরুল বাংলা সাহিত্যে নিজের আসন পাকাপোক্ত করে নিয়ে ছিলেন। অগ্নিবীণা কাব্যের কবিতা গুলি যখন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছিল তখন থেকেই নজরুল বিপুল ভাবে সংবর্ধিত হন। সাধারণ পাঠক ও বিদগ্ধ সমালোচক উভয় মহলে রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্যে মৌলিক কণ্ঠস্বর হিসেবে নজরুল স্বীকৃতি পান। এর মূলে ছিল নজরুলের বিদ্রোহী চেতনা। যার উৎস মানবতার প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা, শ্রেণিহীন সাম্যবাদ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। বিদ্রোহ কবিতাতেই তিনি তার লক্ষ্য ও দায়িত্ব সর্ম্পকে স্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছেন।

মহা বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবেনা,

অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না

মহা বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত।

প্রাগৈতিহাসিক গল্পের ভিখু চরিত্র আলোচনা

নজরুলের এই বিদ্রোহের মূলে ছিল তার ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিক অভিজ্ঞতা, যুদ্ধক্ষেত্রের বীভৎস দিনের স্মৃতি এবং সর্বোপরি অচরিতার্থ প্রেমিক হৃদয়ের অর্পূণ আকাঙ্খা। শুধূ অগ্নিবীণা কাব্যেই নয় নজরুল মানসের প্রতিনিধিত্বমূলক কবিতা “বিদ্রোহী”। অমিত্বে যে চরম প্রকাশ এই কবিতায় ঘটেছে বাঙলা কাব্যে তার দ্বিতীয় কোন উদাহরণ নেই।

পরাধীনতার জ্বালা নিঃসন্দেহে নজরুলের বিদ্রোহী বহ্নি বহুলাংশে প্রজ্জলিত করেছে, কিন্তু শুধু দেশের স্বাধীনতা লাভে তার বিদ্রোহ চিত্তের তৃপ্তি হত না। তার বিদ্রোহের রূপ ছিল আরো ব্যপক। তা ছিল একাধারে ভাববাদী ও বস্তুবাদী। এক পর্যায়ে তা সকল আইন কানুনের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ, ইতিহাস নন্দিত চেংগিসের মত নিষ্ঠুরের জয়গানেও মুখর, তাই তার কণ্ঠে আমরা শুনি ....

আমি মানিনাকো কোন আইন,

আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন !

অন্যত্র কবি বলেন....

আমি বেদুইন আমি চেংগিস

আমি আপনাকে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।

অগ্নিবীণা কাব্যের কবিতা গুলির শিরোনাম যাই হোক না কেন তার অন্তর্নিহিত ভাব মূলত এক। অমিত বীর্যধারী এক অকুতোভয় সৈনিকের প্রচণ্ড দাপটে বাংলা কাব্যের কোমল ভূমি কম্পিত। প্রথাবদ্ধ জীবনের সকল স্তরে তার আঘাত মানুষের অন্তরকে উস্কে দিয়েছিল। জীবনের সাধনা মানেই যে যৌবনের সাধনা এই কথাটি নজরুল বাঙালীর প্রাণের প্রকোষ্ঠে নতুন করে প্রবিষ্ট করালেন। তাই তার কবিতায় নায়ক হয়ে উঠলেন আইন না মানা দুঃসাহসী পুরুষ, যে কিনা ভগবানের বুকে পদচিহ্ন আঁকতে কুণ্ঠাবোধ করে না।

রবীন্দ্র গল্পে সমাজ এখানে

রক্তাম্বর ধরণীর মা কবিতায় তিনি হিন্দু দেবী রূপ দেখে শক্তির উৎস হিসেবে কল্পনা করে দুঃসাহসে উচ্চারণ করলেন ....

নিদ্রিত শিবে লাথি মার আজ

ভাঙো মা ভোলার ভাঙ নেশা।

 

কামাল পাশা ও “আনোয়ার কবিতায় তিনি মধ্য প্রাচ্য ও আরব এলাকায় দুটি ইতিহাস খ্যাত চরিত্র হিসেবে তার কবিতায় নায়কের মর্যাদা দিয়েছেন। আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল পাশাকে তিনি পরাধীন ভারতের মুক্তির দিশারী হিসেবে কল্পনা করেছেনে। অন্যদিকে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামি আনোয়ার কে দিয়েছেন বীরের মর্যাদা।

এদেশের দ্বিধা গ্রস্থ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও হতাশা বিহবল সাধারণ মানুষের মনে তার কবিতা গুলি আগ্নেগিরির আগ্ন্যোৎপাতের মত অন্তজ্বালা সৃষ্টি করেছিল। তাই নিঃসংকোচে বলা যায় যে, রাজনৈতিক স্বাধীনতার আকাঙ্খা নজরুলের কাব্যে একটি প্রধান সুর। বাংলা সাহিত্যে তিনিই ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সাহিত্যের তরবারি নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন।

কবি মাত্রই প্রেমিক আর প্রেম মাত্রই বিরহের অংশীদার। নজরুল চিরকালই বিরহী আত্মার প্রতিনিধি না পাওয়ার দুঃসহ বেদনায় তিনি উৎক্ষিপ্ত মানসের অধিকারী। তাই বিদ্রোহের মত কবিতা লিখতে গিয়েও প্রেম সত্তাকে তিনি পুরোপুরি বির্সজন দিতে পারেন নি। তাই সে বিদ্রোহী কাউকে নিজেকে ছাড়া কাউকে কুর্নিশ করেন না, সেও বলে ....

আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি ছল করে দেখা অনুক্ষণ,

আমি চপল মেয়ের ভালবাসা, তার কাফন চুড়ির কনকন।।

নজরুলের প্রেমিক সত্তার ক্রন্দন অধিকাংশ ক্ষেত্রে অব্যক্ত যন্ত্রনায় কাতর। প্রকৃত অর্থে নজরুলের ভেতর সর্বদা একটি অস্থির দ্বৈতসত্তা বিদ্যমান ছিল। কিন্তু সামগ্রিক বিচারে তার সকল পরিচয় ছাপিয়ে তার বিদ্রোহী সত্তার জয়জয়কার সুনিশ্চিত হয়েছে। আর এই বিদ্রোহী নজরুলের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ স্মারক তাঁর “অগ্নিবীণাকাব্য।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন