নাট্যকার হিসেবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সার্থকতা আলোচনা কর।

 


প্রশ্ন- নাট্যকার হিসেবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সার্থকতা আলোচনা কর।

 

    সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বহিপীর প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে রচিত হয় আরো আগে ১৯৫৫ তে। বহিপীর দু-দৃশ্য বিশিষ্ট একটি সল্পায়তনের নাটক। দৃশ্যকাল হেমন্ত, মোট চরিত্রের সংখ্যা আটজন। বহিপীর নাটকের বিষয়বস্তু বা ঘটনার তেমন কোন জটিলতা নেই। নাটকটির কাহিনী সরল কিন্তু নাট্যকারের সংলাপের মাধ্যমে তাতে সাসপেন্সের প্রবাহকে গতিমান করেছেন, ফলে সৃষ্ট হয়েছে কাহিনীর গভীরতা।

    বহিপীর নাটকের পটভূমিকা পল্লী সমাজ হলেও আধুনিক নর নারীর মনে যে আত্ম অধিকারের দাবী আজ আমাদের সমাজে এসে লেগেছে তারই প্রতিফলন ঘটেছে এখানে। পীর মুর্শিদ ভক্তি আমাদের সমাজে মজ্জাগত সংস্কার। কিন্তু মানবিক অধিকারের দাবীতে যে এ সংস্কারে শৈথিল্য এসেছে তারই কিছুটা ছাপ আমরা এ নাটকে দেখতে পাই। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বহিপীর নাটকে তিনটি বিষয়ের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন, আর তাহল  ক) জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হবার উপক্রম, খ) পীর ফকিরের উপর মানুষের আস্থা ক্রমশ কমে যাচ্ছে, গ) হৃদয়বৃত্তি ও নতুন জীবনের স্বীকৃতি রয়েছে।

    নাটকের কাহিনীসূত্র এটি : জমিদার হাতেম আলী বজরায় বেরিয়েছেন, সঙ্গে তার স্ত্রী খোদেজা এবং পুত্র হাশেম। নদীতে বজরা ঝড়ে পরায় একটা খালের ভেতরে এনে রাখা হয় । খালে ঢোকার সময় একটা নৌকার সঙ্গে বজরার ধাক্কা লাগে, এবং সেই নৌকা থেকে একজন পীর সাহেব তাদের বজরায় আশ্রয় নেন। ইনিই বহিপীর বইয়ের ভাষায় কথা বলেন বলে তার এরকম নামকরণ। বৃদ্ধ ও বিপত্নীক এই পীরসাহেব তার একজন ভক্ত মুরিদের তরুণী কন্যাকে বিয়ে করেন, কিন্তু বিয়ের রাতেই তার স্ত্রী উধাও হয়। সেই পলাতকা তরুণী তাহেরাও আশ্রয় নেয় হাতেম আলরি বজরায়। বহিপীর তাহেরাকে খুঁজছেন। তাহেরা বহিপীরের হাত থেকে বাঁচতে চায়। এদিকে হাতেম আলীর জমিদারি নিলামে উঠবে, তা নিয়ে তিনি মহা-উদ্বিগ্ন। বহিপীর প্রথমে জানতে না পারলেও, পরে জেনে যান যে তার বিয়ের রাতের উধাও স্ত্রী ঐ বজরাতেই আছে। বহিপীরের প্রবল ইচ্ছা ও চেষ্টা সত্ত্বেও তরুণী তাহেরা তার সঙ্গে যায় না। শেষ-পর্যন্ত সমস্ত কিছুর সমাধান হয় : তাহেরাকে নিয়ে চলে যায় হশেম, বহিপীরের ব্যবস্থায় হাতেম আলীর জমিদারিও রক্ষা পেয়ে যাবার আভাস দিয়ে নাটক শেষ হয়।

প্রাগৈতিহাসি গল্পের ভিখু চরিত্র দেখুন

    সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর আরেকটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক তরঙ্গ ভঙ্গ নাটকটি একটি বিচারকের কাহিনী নামে ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। তরঙ্গ ভঙ্গ নাটকের চরিত্র সমূহ দটো দলে বিভক্ত এক দল সত্যানুসন্ধানী এবং অপর দল স্বার্থবাদী ভ- সমাজের প্রতিনিধি। প্রথম দলে রয়েছে:- জজ, ভিখারিণী, যুবক, মতলুব আলী। দ্বিতীয় দলে আছে আব্দুস সত্তার নেওলাপুরী, উকিল, বারিশপীর এবং কিছু জনতা । 

    এই নাটকটি তিন দৃশ্যে সমাপ্ত হয়েছে। নাটকের কাহিনীসূত্র এটি আমেনা নান্মী এক দরিদ্র নারী ক্ষুধার্ত শিশু সন্তানকে খাবার দিতে না পেরে হত্যা করেছে। আদালতে তার বিচার চলছে। বিচারে সম্ভাবত জজ তাকে ফাঁসির হুকুম দেবেন। সমগ্র নাটকটি এই বিষয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু এমনকি শেষ দৃশ্যে যে দিবালোকের স্পষ্টতার কথা একটু আগে বললাম, তাও সর্বাংশে সত্য নয়। এই নাটকে সমস্তই যেন অর্ধোচ্ছাদিত, বা এমনকি পুরোপুরিই সংগুপ্ত। আমেনা সত্যিই তার শিশু সন্তানকে হত্যা করেছিল কি না তা আমরা জানি না। বিচারকের রায় দেবার আগেই নাটকটি শেষ হয়। আর বিচারসভা বা আদালতের যে-দৃশ্য তাও এক প্রহসনের মতো মনে হয়।

    আমেনা নিজ নিজ অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছে আমেনা স্বামী বা সন্তান হত্যা করেছে তাদের দুঃখ নিবারণের জন্য মৃত্যুর পর তারা সুখ রাজ্যে বসবাস করবে এ আশায় আত্মহত্যা করতে গিয়ে সে ফিরে এসেছে, জীবিত সন্তানদের উপস্থিতি তাকে মরতে দেয়নি, সে বাঁচতে চেয়েছে।

    প্রচ্ছন্ন কিংবা রহস্যের নাটক সুড়ঙ্গ। রেজ্জাক সাহেবের মেয়ে রাবেয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে, একদিন পরেই তার বিয়ে। ওদিকে জনরব মোতাবেক রাবেয়ার চাচাতো ভাই কলিমুদ্দিন ও জনৈক যুবক সুড়ঙ্গ কেটে গুপ্তধন পাবার আশায় রাবেয়ার ঘরে ঢুকেছে। রাবেয়া অসুখের ভান করে দুদিন থেকে না খেয়ে বিছানায় শুয়ে সেই সুড়ঙ্গ কাটার শব্দ শুনছে। দুই জন প্রতিযোগী। এক জন কলিম ফকিরী পোশাক পরে কৌশলে তা পেতে চায়, আর অপর জন পরিশ্রম করে সুড়ঙ্গ কেটে তার সন্ধান নিতে চায়। দু’জনের উদ্দেশ্য মূলত অভিন্ন; কিন্তু তা পাওয়ার পদ্ধতি ভিন্ন। আর এখানেই প্রকৃত রহস্য নিহিত।

রবীন্দ্র গল্পে সমাজ ও মানুষ প্রবেশ করুন

    আসলে, সুড়ঙ্গ একটি রূপক নাটক। এর সাধারণ বা বাহ্যিক বক্তব্য: দু’জন যুবক বা বয়ঃসন্ধিকালের বালকের গুপ্তধন উদ্ধার প্রচেষ্টা যা কিশোর বা বালকসুলভ মানসিকতার প্রকাশ, এবং যার পেছনে উদ্দেশ্য রয়েছে হাস্যরস সৃষ্টি। আর নাটকটির অর্ন্তনিহিত অর্থ হচ্ছে : দু’জন যুবক মনে মনে রাবেয়াকে কামনা করে, ভালোবাসা পেতে চায়, কিন্তু রাবেয়ার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা দু’জনেই উপস্থিত হয়েছে সশরীরে। এদের একজন তার চাচাতো ভাই কলিম, যে সহজেই রাবেয়ার মনোজগতে প্রবেশ করতে চেয়েছে ; অন্যজন জনৈক যুবক, যে প্রেমের ক্ষেত্রে নিষ্ঠাবান। এদের প্রতি রাবেয়ার সহানুভতি আছে, কৌতুহল আছে কিন্তু গ্রহণ করার মতো অবস্থা নেই। সে বাবার মনোনীত ছেলেকেই বিয়ে করতে রাজী হয়েছে। সুড়ঙ্গ কেটে গুপ্তধন উদ্ধার, অথাৎ ভালোবাসার পথ ধরে রাবেয়াকে পাবার আকাঙক্ষা।

    বিশ শতকের মানুষের জীবনের কোন গল্প নেই। ঈশ্বরহীন পৃথিবীতে সে নিয়ত একা। গভীর অনিকেতবোধ, অপার শূন্যতা চেতনাকে বহন করেই সে প্রাণ ধারণ করে আছে, ভোগ করে চলেছে তারই পুনরাবৃত্ত জীবনের গ্লানি, দুঃখবোধও বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা। উজানে মৃত্যু এই বিপন্ন মানব- চৈতন্যের কথাবস্তু। উজানে মৃত্যু গল্পহীনের গল্প, ঘটনাহীনদের বিচূণিত ঘটনাপুঞ্জের সমাহার, নৌকাবাহক, কালো ও সাদা পোশাক পরিহিতের দুর্বার জীবনানুভূতির প্রতীতি।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন