ভিখু প্রবলভাবে সংগ্রামশীল ও অস্তিত্ববাদী। ভিখু চরিত্র আলোচনা।

 



প্রশ্ন: ভিখু প্রবলভাবে সংগ্রামশীল ও অস্তিত্ববাদী। 

ভিখু চরিত্র আলোচনা বা বিশ্লেষণ কর। 


    ত্রিশোত্তর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম রূপকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা কথা সাহিত্যে সমাজের নিন্ম স্তরের মানুষের কথা তুলে ধরেছেন। মানুষের অন্তজীবনের প্রতি ফ্রডেীয় এবং মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সমাজ বাস্তবতার অভিব্যক্তি তার সাহিত্য কর্মে স্পষ্ট রূপ নিয়েছে। তার লেখা “প্রাগৈতিহাসিক গল্প তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এই গল্পে লেখক অসভ্য অশিক্ষিত মানুষের জীবনাচরণ কে মূল উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ভিখু এই অসংস্কৃত সমাজ জীবনের সার্থক প্রতিনিধি। ভিখু চরম সংগ্রামী ও চুড়ান্ত অস্তিত্ববাদী।

    জগতে টিকে থাকা, চেতন - অচেতন সব বস্তুর সঙ্গে কোন না কোন ভাবে সংযুক্ত থাকা, সংবদ্ধ থাকা এর নাম অস্তিত্ব। এই অস্তিত্ব থেকেই অস্তিত্ববাদ কথাটির উৎপত্তি। যে ব্যক্তি যে কোন অবস্থায় নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে, সেই অস্তিত্ববাদী।

রবীন্দ্র গল্পে সমাজ ও মানুষ নোটটি এখানে

    জীবন মানেই সংগ্রাম। জীবনে টিকে থাকতে হলে সংগ্রাম অনিবার্য। মানুষ ইচ্ছা শক্তির দ্বারা তাড়িত হয়েই কিছু করে, অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়। ইচ্ছা শক্তির দ্বারা তাড়িত হয়ে কোন কিছু বাস্তবায়িত করার প্রচেষ্টা কে বলে সংগ্রামশীলতা।

    এখন আমরা ভিখু চরিত্র আলোচনা প্রসঙ্গে প্রমাণ করার প্রয়াস পাব যে, “ভিখু প্রবলভাবে সংগ্রামশীল ও অস্তিত্ববাদী।

    প্রাগৈতিহাসিক গল্পে ভিখুর জীবন বৃতান্ত তেমনভাবে পাওয়া যায় না। তার পিতা মাতা, আত্মীয়-স্বজন, বা বাস স্থানের পরিচয় লেখক দেন নি। একজন ডাকাত সর্দার হিসেবে তার পরিচয় মেলে। এই কর্ম করতে গিয়ে এমন কোন অপকর্ম নেই যা সে করে না। ভিখু কেবল একটি ডাকাতের নাম নয়, নৃশংসতার মূর্ত প্রতীক।

    দুর্ধর্ষ ডাকাত সর্দার ভিখু নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য ডাকাতি পেশাকে বেছে নেয়। পেশার তাগিদে সে মানুষ খুন করতেও দ্বিধা বোধ করত না। বনের মধ্যে দীর্ঘ দিন যাবত প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সি নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। বৈকুণ্ঠ সাহার গদিতে ডাকাতি করতে গিয়ে ভিখু কাধে একটা বর্শার খোচা খেয়ে পঙ্গু হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করেছে, তবু অস্তিত্বে প্রশ্নে সামান্যতম ছাড় দেয় নি।

জীবননান্দ দাশের কাব্যে মৃত্যুচেতনা এই লিঙ্কে

    সংগ্রামশীল ভিখু জীবনের কাছে কখনও নতি স্বীকার করে নি। হাজারো প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে লড়তে হয়েছে তাকে। বর্ষাকালে যেখানে বাঘ পর্যন্ত বাস করে না, সে বনে বাঁশের মাচার উপরে অনেক দিন থাকতে হয়েছে ভিখুকে। পেহ্লাদ তাকে আশ্রয় দেয় তবে বাড়িতে নয় বনে। পেহ্লাদ বলে “বাদলায় বাঘ টাঘ সব পাহাড়ের উপরে গেছে গা। সাপে যদি না কাটে তবে আরাম করে থাকবি ভিখু।

    দুর্দান্ত পশু শক্তির অধিকারী ভিখু তার আদিম জৈবিক ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য অসংখ্য নারীর সম্ভ্রম হানী করে কামুকতার পরিচয় দিয়েছে। সে নারী দেহ ভোগ করে চরম পুলক অনুভব করত। কামের বর্শবর্তী হয়ে সে পানাহার শ্রীপতি বিশ্বাসের বোনকে অপহরণ করেছিল, রাখুবাগদির বৌ কে নিয়ে হাতিয়ায় পালিয়েছিল, পঙ্গুত্ব বরণের পরপরই আশ্রয় দাতা পেহ্লাদের স্ত্রীর হাত চেপে ধরেছিল যৌন তৃপ্তি লাভ করার জন্য।

    অত্যন্ত হিংস্র স্বভাবের ভিখু ডাকাতি করতে গিয়ে অনেক মানুষ খুন করেছে। মায়ের সামনে পুত্র ও স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ভোগ করে বিকৃত তৃপ্তি লাভ করেছে। অবৈধ কামনা চরিতার্থ করতে গিয়ে বসিরের মাথায় লোহার রড ঢুকিয়ে দিতে দ্বিধা করে নি সে।

    চরিত্র মানব জীবনের অন্যতম মূল্যবান সম্পদ হলেও ভিখু দুশ্চরিত্র মানুষের জলন্ত প্রতিমূর্তি ছিল। সে পানাহার শ্রীপতি বিশ্বাসের বোনকে অপহরণ করেছিল, রাখুবাগদির বৌ কে নিয়ে হাতিয়ায় পালিয়েছিল, পাঁচীর দিকে হাত বাড়ায়, নদীর ঘাটে স্নান করতে নামলে ভিক্ষা চাইবার ছলে জলের ধারে গিয়ে দাড়ায়। মেয়েরা ভয় পাইলে সে খুশি হয় এবং সরে যেতে বললে সে নড়েনা দাঁত বের করে দুবির্নীত হাসি হাসে।

নজরুল কাব্যে সাম্যবাদ দেখুন

    পশু প্রবৃত্তির অধিকারী ও বদ মেজাজী ভিখুকে কেউ ভিক্ষা না দিলে বিশ্রী রকমের মন্তব্য করে নানা রকম গালাগাল করত। সামান্য এক পয়সার জিনিস কিনে ফাও না দিলে দোকানদার কে মারধর করতে উদ্যত হত। ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করে সে বুঝতে পারল যে, এ পেশায় মেজাজ দেখানো থাকবে না। তাই কৌশলী ভিখু কয়েক দিনের মধ্যে ভিক্ষার যাবতীয় কৌশল আয়ত্ত্বে এনে নিজেকে একজন পঙ্গু ভিক্ষুকে পরিণত করে।

    আদিম, বন্য ও বর্বর মানসিকতার ভিখুর মধ্যে কোন সুকুমার প্রবৃত্তির বিকাশ সাধিত হয় নি। সে ছিল বনের পশুর মতই বন্য ও প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের মতই আদিম। তার চাল চলন, আচার আচরণ, কাজ কর্ম, কথা বার্তার মধ্যে কোন রুচিশীলতা ছিল না।

    উপোরক্ত আলোচনা থেকে একথা প্রতীয়মান হয় যে, মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রধান হাতিয়ার হল সংগ্রাম বলে ভিখু প্রচ-ভাবে সংগ্রামী এবং সেই কারণে সে অস্তিত্ববাদী। টিকে থাকার জন্য যখন যা কিছু প্রয়োজন তখন সে তা করেছে। বাচার সংগ্রামের ক্ষেত্রে সে কারো সাথে আপোষ করে নি। ভিখু বশির কে হত্যা করেছে পাঁচীর লোভে, বৈকুণ্ঠ সাহার গদিতে ডাকাতি করেছে উপার্জনের প্রয়োজনে, পেহ্লাদের বউয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছে কাম লালসা চরিতার্থ করার মানসে, ভিক্ষা বৃত্তি গ্রহণ করেছে বেঁচে থাকার তাগিদে। সুতরাং ভিখু সংগ্রামশীল ও অস্তিত্ববাদী ।

 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন