বিচিত্র প্রবন্ধ সমালোচনা। পাগল প্রবন্ধ আলোচনা।
প্রশ্ন- “পাগল” প্রবন্ধের মূল বক্তব্য লিখ।
রবীন্দ্রনাথ মূলত কবি,
বিশেষ করে রোমান্টিক কবি। কবিতার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ গল্প, নাটক, উপন্যাস এবং প্রচুর
পরিমাণে প্রবন্ধ রচনা করেছেন। এই প্রবন্ধের সংখ্যা যেমন প্রচুর, তেমনি এর বিষয়ও বৈচিত্র্য পূর্ণ। আর এই বিপুল সংখ্যক প্রবন্ধের মধ্যে সমাজ মনস্ক রবীন্দ্রনাথ, দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ
এবং চিন্তাশীল রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাই। তাঁর পাগল প্রবন্ধে তিনি তেমনি এই বৃহৎ জগতের
মানব জীবনের এক দার্শনিকতাকে চমৎকার ভাবে প্রকাশ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রচুর
রচনায় নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। প্রবন্ধের ক্ষেত্রেও তাঁর কোন ব্যতিক্রম ঘটে
নি। রোমান্টিক কবির হাতে প্রবন্ধও কখনো কখনো কবিতা হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে ভাবনার গভীরতা,
আবেগ এবং ভাষার লালিত্যে। ‘পাগল’ প্রবন্ধটি পাঠ করলে প্রথমেই আমাদের মনে হতে পারে আমরা
কোন একটি গল্প পড়ছি। পশ্চিমের কোন এক ছোট্ট শহরের বর্ণনা দিয়ে তিনি তাঁর বক্তব্য শুরু
করেছেন। কিন্তু একটু পরেই বুঝা যায় তিনি কোন এক দার্শনিক প্রত্যয়ের অবতারণা করছেন।
রবীন্দ্রনাথ ‘পাগল’
প্রবন্ধে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, বিশ্ব সংসারে মানুষ প্রকৃত
পক্ষে দু ধরণের- সাধারণ মানুষ যারা সংখ্যাধিক্য আর প্রতিভাবান মানুষ যারা সংখ্যা লঘু।
এই সংখ্যা সাধারণ মানুষ জগত সংসারে নানা উপাদান-উপকরণ প্রত্যাহিক জীবনে অভ্যাস মত কাজে
লাগিয়ে নানা রকমের কাজ কর্মে ব্যস্ত থাকে এবং জগৎ সংসার ও সমাজ সংসারের প্রচলিত রীতি
নীতিকে মেনে নিয়ে খুবই নিরানন্দ ও আটপৌরে জীবন অতিবাহিত করে। সাধারণ মানুষের মধ্যে
সৃজনশীলতার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় না, সেজন্য সে প্রচলিত নিয়মের সীমানার মধ্যে থেকে
আর দশজনের সঙ্গে একাকার হয়ে বৈশিষ্ট্য বর্জিত অবস্থায় বসবাস করে। অথচ প্রতিভাবান মানুষ
সর্বদাই সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে পরিচিত এবং বিবেচিত। যেহেতু তারা সৃষ্টিশীল মানুষ সেহেতু
তাঁরা প্রচলিত রীতি নীতির মধ্যে আবদ্ধ থাকতে চান না এবং থাকতে পারেন না। তখন তাঁরা
সৃষ্টি ছাড়া খ্যাপামিতে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরেন এবং নব নব সৃষ্টিতে তাঁরা আনন্দিত
হন। সমাজে প্রচলিত নিয়মের মধ্যে তাঁরা থাকতে পছন্দ করেন না বলেই সে নিয়ম ভাঙতে তাদরে
আনন্দ আর সে নিয়ম ভেঙে সেখানে নতুন নতুন নিয়ম প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে তারা আনন্দ খুঁজে
পান। সাধারণ মানুষ যে নিয়মের মধ্যে সারা জীবন তাদের মত করে কাটিয়ে দেয় প্রতিভাবানরা
তাকে প্রত্যাখান করে, তাঁরা তাকে ভেঙে চুরে এর বাইরে এসে দাড়ায়। ফলে সাধারণ মানুষ ঐ
সকল প্রতিভাবানকে খ্যাপা বা পাগল বলে অভিহিত করে।
আলোচ্য প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ
বলেছেন ‘পাগল’ শব্দটা আমাদের কাছে ঘৃণার শব্দ নহে। খেপা নিমাইকে আমরা খ্যাপা বলিয়া
ভক্তি করি-আমাদের খেপা দেবতা মহেশ্বর। প্রতিভা খেপামির এক প্রকার বিকাশ কিনা এই কথা
লইয়া য়ুরোপে বাদানুবাদ চলিতেছে- কিন্তু আমরা এ কথা স্বীকার করিতে কুণ্ঠিত হই না। প্রতিভা
খ্যাপামি বৈকি তা নিয়মের ব্যতিক্রম, তাহা উলট পালট করিতেই আসে- তাহা আজিকার এই খাপ
ছাড়া সৃষ্টি ছাড়া দিনের মতো হঠাৎ আসিয়া যত কাজের লোকের কাজ নষ্ট করিয়া দিয়া যায় কেহবা
তাকে গালি পাড়িতে থাকে, কেহবা তাহাকে লইয়া নাচিয়া কুঁদিয়া অস্থির হইয়া উঠে।
রবীন্দ্রনাথ সল্প কথায়
এবং প্রাঞ্জল ভাষায় পাগল বা খেপাকে আমাদের সামনে পরিস্কার ভাবে তুলে ধরেছেন। প্রতিভাবান
সমাজে দশজনের মধ্যে একজন হয়ে থাকতে চায় না এবং পারেও না। দশজন থেকে সে স্বতন্ত্র সমাজে
সাধারণ মানুষের কাছে সে অপরিচিত সকল বিপরীত কাজের সে কাজী সেজন্যই সে তাদের কাছে খ্যাপা
বা পাগল বিবেচিত হয়। এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে মেধা মননে চিন্তায় সৃষ্টিশীলতায় সাধারণ
মানুষ এসব প্রতিভাবানদের স্তরে উন্নীত হতে পারে না তাই তার সীমিত জ্ঞানের কাছে প্রতিভাবানরা
পাগল বলে বিবেচিত।
ভোলানাথ আনন্দময় দেবতা
তিনি সকল দেবতার মধ্যে ভিন্ন রকম। ক্ষণে ক্ষণে তাঁর আর্বিভাবে সাধারণ মানুষের হিসেবী
জীবনের ছন্দের তাল লয় কেটে একবারে ওলট পালট করে দেয়। ভোলানাথের শুভাগমনে আমাদের আনন্দ।
সে আনন্দ আমাদের জীবনকে নতুন ভাবে পূর্ণ করে দেয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন সাধারণ হিসেবী
মানুষ ও খ্যাপার মধ্যে যে পার্থক্য তা সুখ ও আনন্দের পার্থক্যের সাথে তুলনীয়। রবীন্দ্রনাথের
মতে ‘ সুখ প্রতিদিনের সামগ্রী, আনন্দ প্রত্যহের অতীত। সুখ শরীরের কোথাও পাছে ধূলা লাগে
বলিয়া সংকুচিত, আনন্দ ধূলায় গড়াগড়ি দিয়া নিখিলের সঙ্গে আপনার ব্যবধান ভাঙ্গিয়া চুরমার
করিয়া দেয়; এইজন্য সুখের পক্ষে ধূলা হেয়, আনন্দের পক্ষে ধূলা ভূষণ। সুখ পাছে কিছু হারায়
বলিয়া ভীত, আনন্দ যথাসর্বস্ব বিতরণ করিয়া পরিতৃপ্ত, এইজন্য সুখের পক্ষে রিক্ততা দারিদ্র্য,
আনন্দের পক্ষে দারিদ্র্যই ঐশ্বর্য’।
জগতের সকল সৃষ্টির মধ্যে
একটি পাগল আছেন, যা কিছু অভাবনীয় তা তিনি টেনে এনে আমাদের মুখোমুখি করে দেন। পাগল এবং
প্রতিভাবান উভয়েই দশের বাইরে। পাগল সব সময় নিখিলকে নিয়মের বাইরে টানছেন। সমাজ চির পুরাতন
নিয়মেই চলে, আর পাগল তাকে প্রতিনিয়ত সেই নিয়মের বাইরে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করছে আর
এখানেই পাগলের সাথে সমাজের দ্বন্দ্ব সংঘাত। পাগল এবং প্রতিভাবান উভয়েই প্রচলিত সমাজের
বাইরে অবস্থান নেয় অর্থ্যাৎ দশের সাথে তার মিল নেই। পার্থক্য এখানেই যে, পাগল দশজনের
বাইরে থেকে যায় আর প্রতিভাবান দশকে একাদশে পরিণত করে দশের অধিকার পড়িয়ে দেয়।
পরিশেষে বলতে পারি রবীন্দ্রনাথ
তার ভাবনার গভীরে প্রবেশ করে সমাজের অতি সাধারণ বিষয়কে অসাধারণ মনীষায় ব্যাখা দিয়ে
পাগল এবং প্রতিভাবানকে অতি কাছাকাছি অবস্থানে নিয়ে এসেছেন। আমরা যারা সাধারণ স্তরের
মানুষ প্রচলিত সীমাবদ্ধ নিয়মের মধ্যে আমরা যারা যাতায়ত করি তাদের চোখে পাগল ঘৃণ্য বস্তু।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রমাণ করেছেন যারা খ্যাপা তারা নিয়ম ভাঙ্গার আনন্দে আত্মহারা আর
আমরা সাধারণ মানুষ পাছে নিয়ম ভেঙ্গে যায়, এই ভয়ে ভীত। ফলে আমাদের উচিত জরুরী কাজের
বোঝা যার সংসারের ভেতরে মূল্য আছে কিন্তু সংসারের ভিতরে মূল্য আছে কিন্তু নিখিলের আনন্দের
সাথে যোগ নেই, তাকে পাগলের তা-ব নৃত্যের কাছে সমর্পণ করাই শ্রেয়।