প্রশ্নঃ- প্রমথ চৌধুরীর গদ্য রীতির বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
Style is the man অর্থ্যাৎ স্বকীয়তাতেই মানুষের পরিচয়।
একজন লেখকের ক্ষেত্রে একথাটি সর্বাংশে সত্য। প্রকাশের ভঙ্গিতেই একজন লেখকের নিজস্ব
ব্যক্তিত্ব চিহ্নিত হয়। তাই রচনা রীতি শুধু বাইরের রীতি বা ভঙ্গি নয়, তা লেখকের আত্মপ্রকাশের
আন্তরিক মাধ্যম। বাংলা সাহিত্যের বিশেষ যুগে বিশেষ সময়ে অবর্তীন হয়েছিলেন প্রমথ চৌধুরী।
গতানুগতিক ধারায় নিজেকে ভাসিয়ে না দিয়ে একটি নিজস্ব Style বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তন করেছেন, যা রবীন্দ্রনাথে থেকে শুরু করে অনেক লব্ধ
প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক গ্রহণ করেছেন।
বিশিষ্ট লেখক পেটার
সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারে স্টাইলের উপর সবচেয়ে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে সাহিত্য
ও স্টাইল এ দুই যেন একার্থবোধক। তিনি বলেছেন স্টাইলকে বিশ্লেষণ করলে মনোজীবন, আত্মিক
স্বরূপ ও ব্যক্তিত্ব এই তিনটি জিনিসই পাওয়া যায়।
প্রমথ চৌধুরী বাংলা
গদ্যে যে বিশেষ রীতি প্রবর্তন করেছেন, তার মধ্যে একটি স্টাইল ফুটে উঠেছে। তাঁর লেখার
মধ্যে অসাধারণ একটি স্বাতন্ত্র্যই পরিচয় করিয়ে দেয় যে এটি প্রমথ চৌধুরীর রচনা। নিন্মে
আমরা গদ্য রচনার কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করব।
সাহিত্যের
ভাষা হিসাবে চলিত ভাষার প্রতিষ্ঠাদান: সেই উইলিয়াম কেরির ‘কথোপকথন’ এই বাংলা চলিত ভাষার প্রথম স্ফুরণ লক্ষ্য করা গেলেও এবং মাঝখানে
‘আলালী ও হুতোমীয়’ গদ্যের আর্বিভাব ঘটলেও প্রমথ চৌধুরীকেই
আধুনিক গদ্যের অন্যতম প্রর্বতকের মর্যাদা দেওয়া হয়। বঙ্কিমচন্দ্র আলালী ভাষাকে সম্মাননা
জ্ঞাপন করেছিলেন, কিন্তু বীরবল গদ্যের স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন নি। প্রথম চৌধুরী জন্মেছিলেন
পাবনায়, বেড়ে উঠেছিলেন কৃষ্ণনগরে এবং এই কৃষ্ণ নাগরিক বাচনভঙ্গি তাঁর ভাষাকে আবশ্যম্ভাবীরূপে
প্রভাবিত করেছিল। ভাগীরথী তীরবর্তী মানুষের মুখের ভাষাকে তিনি আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন-তার
উপর আপন বুদ্ধিদ্বীপ্ত সচেতন শব্দ প্রয়োগের কারুকাজে একটি সর্বজন রীতির উদ্ভাবন করেছিলেন।
মুখের ভাষা যে গদ্যে ব্যবহৃত হওয়ার যোগ্য এ সম্পর্কে তিনি বলেন-“আমরা যদি সংস্কৃত ভাষার
দারস্থ না হয়ে ঘরের ভাষার উপরেই নির্ভর করি তাহলে আমাদের লেখার ঢাল স্বছন্দ এবং আমাদের
ঘরের লোকের সঙ্গে মনোভাবের আদান প্রদানটাই সহজ হয়ে আসবে।” তিনি গোটা বাংলা গদ্যের কাঠামো কে ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন-তাই
তাঁর গদ্য রীতির মৌলিক উপাদান হলো ভাষা ব্যবহারে স্বতন্ত্র কুশলতা।
রবীন্দ্রনাথের শেষলেখা কাব্যে মৃত্যুচেতনা লিঙ্ক
বাকচাতুর্য:
কথা বলার কায়দা বা বাকচাতুরী বীরবল গদ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি অকৃত্রিম সরলতাকে
পরিহার করে, কৃত্রিম নিপুণতাকে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন। তাই তাঁর
ভঙ্গি অনেক ক্ষেত্রেই ঘোরানো ও প্যাঁচানো-তার ভাষার গতি যেমন সুক্ষ্ম ও সচতুর তেমনি
এর আঘাত অমোঘ ও নির্মম। তিনি লিখেছিলেন- “আমরা ইউরোপীয় সভ্যতার দিকে তিন পা এগিয়ে আবার
ভারতবর্ষের দিকে দু পা পিছিয়ে আসি, আবার অগ্রসর হই আবার পিছু হটি। এই কুর্নিশ করাটাই
নব সভ্যতার ধর্ম ও কর্ম। এ ধরনের বাকনির্মিতিতে প্রয়োজন স্থিতিস্থাপকতা গুণ যা প্রমথ
চৌধুরীর ক্ষেত্রে ছিল অনায়াসলব্ধ এক প্রচেষ্টা মাত্র।
পরিহাসপ্রিয়তা:
বাতচাতুরীর সঙ্গে হাস্যরসের সম্পর্ক আত্মিক, একমাত্র ছাড়া Humored অন্য যে কোনো শ্রেণির হাস্যরসের মূল উপাদান বাক বৈদগ্ধ্য।
রচনার মধ্যে হাস্য পরিহাস ও অব্যর্থ রসিকতার আমদানি করে প্রমথ চৌধুরী প্রসাদগুণ ও গ্রহণ
যোগ্যতা বৃদ্ধি করতেন। wit ও Satire প্রয়োগে তিনি বাংলা গদ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী
লেখক।
বাগ
বৈদগ্ধ্য: বীরবল গদ্য রীতির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো বিদগ্ধ ও শানিত বুদ্ধির আশ্রয়ে
নির্মিত বাক্ভঙ্গি। বাঙালির স্বভাবজাত ভাবালুতা তিনি যথাসম্ভব পরিহার করেছিলেন-তার
বদলে এনছিলেন ফরাসী দেশীয় বুদ্ধিদ্বীপ্ত ঋজুতাকে। তিনি নিজেকে ফরাসী ভাবতে ভালবাসতেন,
তাই তাঁর ভাষা গীতিধর্মী নয়-ভাস্কর্যধর্মী। তাঁর গদ্যরীতি ভাবাবেগ মুক্ত, অতিশয্যবর্জিত,
ক্লাসিকাল মনের পরিচয়বাহী। বুদ্ধির স্পষ্টালোকে উজ্জ্বল মনের পূজারী তিনি-ভাবাবেগ তাঁর
শত্রু, এই কারণে বাগ বৈদগ্ধ্য তাঁর স্বভাবের অংশ।
তৎসম
শব্দ ও সমাসবদ্ধ পদের আধিক্য: শব্দ ব্যহারের ক্ষেত্রে প্রমথ চৌধুরী ছিলেন নিরসলস প্রেমিকের
মতো পরিশ্রমী ও নিষ্ঠাবান। বক্তব্যের ঋজুতা বাড়ানোর জন্য তিনি তৎসম শব্দের বহুল প্রয়োগ
ঘটিয়েছেন সেই সঙ্গে লঘু ধরনের ক্রিয়াপদ ব্যবহারে আবার বাড়িয়েছেন সরলতা। সমাসবদ্ধ পদ
প্রয়োগেও তিনি অকৃপণ। এসবের মিশ্রণে তাঁর গদ্য রীতিতে বেড়েছে শোষণশক্তি, এসেছে দৃঢ়তা।
তাঁর সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা ছিল বক্তব্যকে দৃশ্যমান করে তোলা।
বলাকা কাব্যে গতিবাদ প্রবেশ করুন
মিতভাষিতা
ও হীরককাঠিন্য: অল্প কথায় অধিক ভাব প্রকাশের ক্ষমতা কোনো লেখকের পক্ষে আয়ত্ত্ব করা
খুব দুরূহ ব্যাপার- প্রমথ চৌধুরী এই বিরল ক্ষমতা যথেষ্ট পরিমাণেই ছিল। বাংলা সাহিত্যের
অতিকথন ও অতিলেখন অতিসহজলভ্য, কিন্তু তিনি আত্মসংযমের দ্বারা এই দুটি ত্রুটি থেকে আত্মরক্ষা
করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মিতভাষণ তাঁর রচনার অন্যতম শ্রেষ্ঠগুণ। ভাষাকে পরিপাটি করে গুছিয়ে
লিখতে তিনি ছিলেন ওস্তাদ শিল্পী। ফরাসী গদ্যের নিয়মিত অধ্যয়ন ও অনুশীলন তাঁকে রচনার
নিপুণ পরিপাট্য সম্পর্কে অধিকতর সচেতন করে তুলেছিলেন। হীরকের দ্যুতি ছিল তাঁর রচনায়,
ভারতচন্দ্রের হীরা মালিনীর প্রতি তিনি এই কারণে পক্ষপাত প্রদর্শন করেছিলেন।
প্রসাদগুণ:
প্রমথ চৌধুরী ভারতচন্দ্রের অনুরাগী পাঠক ছিলেন। ফলে রচনার প্রসাদগুণের প্রতি তাঁর সযত্ন মনোযোগ ছিল। বুদ্ধিদ্বীপ্ত ও সংস্কারমুক্ত
মনের অধিকারী ছিলেন তিনি তাই যাকে ‘সেন্টিমেন্ট’ বলে সেটি তাঁর রচনায় বিলক্ষণ অনুপস্থিত। রস সৃষ্টির জন্য তিনি
রচনার পরিমার্জনা করেছেন বারবার। ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার
সম্পাদক হিসাবেও তিনি অন্যের রচনার দুর্বলতা চিহ্নিত করতেন। তাই অবশ্যম্ভাবীরূপে তিনি
প্রসাদগুণের উপর সমধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।
বিভিন্ন ভাষার শব্দ
ব্যবহার: ‘অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল’ বলেছিলেন
ভারত চন্দ্র, প্রমথ চৌধুরীর আদর্শ না হলেও গ্রহণযোগ্য কবি ব্যক্তিত্ব। অর্থ্যাৎ প্রসাদগুণ
বৃদ্ধি বা রস সৃষ্টির জন্য তিনি অকাতরে কিন্তু প্রয়োজন মাফিক বিদেশি শব্দের প্রয়োগ
ঘটিয়েছেন। শব্দ চয়নে এবং শব্দ গ্রহণে তিনি ভাষার শ্রীক্ষেত্র রচনা করেছেন। সংস্কৃত,
আরবি, ফারসি, দেশি-যখন যেটি ভাব প্রকাশের জন্য উপযুক্ত বলে মনে হয়েছে, সংস্কার শূণ্য
চিত্তে সেটিকে গ্রহণ করেছেন তিনি।
অলঙ্কার,
অনুপ্রাস, প্রবচন প্রভৃতির প্রয়োগ: রচনার বহিরঙ্গ পরিপাটী করার জন্য তিনি যেমন সচেষ্ট
ছিলেন, তেমনি অলংকার, অনুপ্রাস প্রয়োগেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।- “লেখকেরা এই সত্যটি
মনে রাখলে গল্প ছোট হয়ে আসবে, শ্লোক শ্লোক রূপ ধারণ করবে, বিজ্ঞান বামন রূপ ধারণ করেও
ত্রিলোক অধিকার করে থাকবে এবং দর্শন নখদর্পণে পরিণত হবে”- এই উদ্ধৃতির মধ্যে একজন শক্তিমান শব্দ শিল্পীর নিশ্চিত পরিচয়
পাওয়া যায়। তাঁর রচনার অনেক বাক্যই পরবর্তী কালে প্রবচনের মর্যাদা লাভ করেছে। যেমনঃ-
“ব্যাধিই সংক্রামক স্বাস্খ্য নয়”, সুশিক্ষিতি লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত”। এছাড়া যমক, শ্লেষ, বক্রোক্তি, ক্লাইমেক্স, এ্যান্টিক্লাইমেক্স
তাঁর রচনাকে বিশিষ্ট স্বাদুতা এনে দিয়েছে।
বীরবল গদ্য স্টাইল তাই
বলে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। কোন কোন সময় শব্দার্থের খেলায় তিনি এমন মেতে উঠেছেন,
যার ফলে শুধু যে অতিশয্য দোষ ঘটেছে তাই নয় অনেক সময় এর ঢেউ একে মূল বিষয় থেকে অনেক
দূরে সরিয়ে এনেছে। ভঙ্গি যেখানে উৎকৃষ্ট বলার সহায়ক সেখানে একে নিঃসন্দেহে স্বীকার
নিতে হবে। কিন্তু যেখানে উৎকৃষ্টভাবে সব রকম সামঞ্জস্য নষ্ট করে সেখানে শিল্পে দিকেও
ত্রুটি ঘটে। এছাড়া বাঁকানো, প্যাঁচানো ভঙ্গিও বাক চাতুর্যের উপর অতিরিক্ত নির্ভর করলে
গদ্যের স্বাভাবিক সৌন্দর্য নষ্ট হয়।
নজরুলের কাব্যে সাম্যবাদ এই লিঙ্কে
যাই হোক বাংলা গদ্যের
মুক্তির ইতিহাসে বীরবল ঢঙ এক উজ্জ্বল অধ্যায়। বাংলা চলিত গদ্যরীতি প্রবর্তনের ক্ষেত্রে
তাঁর দান অপরিসীম। যার ফলে বাংলা গদ্য সাহিত্য নতুন প্রাণ পেয়ে নতুন করে সাজতে আরম্ভ
করেছে। প্রমথ চৌধুরী বাংলা চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তনে অনন্ত সম্ভবনার যে দ্বারোদঘাটন
করেছেন তার ফলে তিনি চিরদিন চিরসবুজ, চির নবীন হতে বাংলা সাহিত্যাকাশে চিরস্মরণীয় হয়ে
থাকবেন।