প্রশ্ন: নজরুল কাব্যে সাম্যবাদী চেতনা।
বাংলা কাব্যে মানবতার
ক্ষেত্রে নজরুল, মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথের সার্থক উত্তরসাধক। কিন্তু নজরুল মানবতাকে
প্রতিষ্ঠিত করলেন কল্পনার উচ্চমার্গ থেকে প্রত্যক্ষ জীবনে জনসাধারণের স্তরে। মধুসূদনের
দেব-দৈত্য-নরত্রাস রাবণ কিংবা রবীন্দ্রনাথের অসীম রহস্যপূর্ণ মানব আঁর আরাধ্য নয়। লাঞ্ছিত,
নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষই কবি হৃদয়কে আকৃষ্ট করেছে। সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, বেদনা-আঘাতে
কবির সহানুভূতিশীল ও সংবেদনশীল হৃদয়ের কাতরতা প্রকাশ পেয়েছে ‘সাম্যবাদী’ কাব্য
গ্রন্থে।
সাম্যবাদী কাব্য গ্রন্থটিতে
‘সাম্যবাদী’ বা ‘সাম্য’ ছাড়াও ‘ঈশ্বর, মানুষ, পাপ, চোর-ডাকাত, বারাঙ্গনা, মিথ্যাবাদী,
নারী, রাজপ্রজা ও কুলীমজুর’ শীর্ষক কবিতাটি রয়েছে। ‘সাম্যবাদী’ কবিতায়
সাম্যের গানে মানুষের যে ব্যবধান দুর করার কথা বলা হয়েছে, সে ব্যবধান মূলতঃ ধর্মীয়
ব্যবধান, ‘যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ মুসলিম ক্রীশ্চান’ অথবা
মতবাদের ব্যবধান, কনফুসিয়াস’ চার্বাক-চেলা’ কিংবা ধর্ম গ্রন্থের ব্যবধান ‘কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক
ইত্যাদি। নজরুলের সাম্যবাদী কবিতার মূল কথা হল।
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল
কালের জ্ঞান,
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা
খুলে দেখ নিজ প্রাণ।
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম সকল
যুগাবতার,
তোমার হৃদয় বিশ্ব দেউল সকলের
দেবতার।
মৃত পুঁথি-কঙ্কালে দেবতা ঠাকুর খোঁজা
বৃথা, আপন হৃদয়ে তার অনুসন্ধান করতে হবে, বাংলার সহজিয়া বাউলেদেরও এই সাধনা। বস্তুতঃ
‘সাম্যবাদী’ কবিতা মূলত অর্থনৈতিক বা শ্রেণি সচেতনার কবিতা নয়, বরং মরমী সাধনার কবিতা।
মসজিদ এই, মন্দির এই, গির্জা
এই হৃদয়,
এইখানে বসে ঈশা মুসা পেল
সত্যের পরিচয়।
মানুষের হৃদয়কে শ্রেষ্ঠ
ভজনালয়, শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান, সাধনার পাদ পীঠ বিবেচনা করা নিশ্চিতরূপে বাংলার মরমী ঐতিহ্যের
অনুসৃতি তাই নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ কবিতার শেষ কথা। ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির কাবা
নাই’। হৃদয় সাধনার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন ও জয়ধ্বনি উচ্চারণ যে ‘সাম্যবাদী’ কবিতার মুখ্য
আবেগ, কবি এখানে মরমী সাধক।
মানি না গির্জা, মঠ, মন্দির,
কলকি পেগম্বর,
দেবতা মোদের সাম্য দেবতা
অন্তরে তাঁর ঘর।
কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের নোট পেতে ক্লিক করুন
‘মানুষ’কবিতায় সাম্যের গান গাইতে গিয়ে কবি ঘোষণা করেছেন যে,
মানুষের চেয়ে বড় বা মহীয়ান কিছু নেই, মানুষের মধ্যে দেশ কাল পাত্র ভেদ অস্বীকার করে
এক অভেদ ধর্ম জাতির কল্পনা করা হয়েছে। লক্ষণীয় যে, ‘মানুষ’কবিতাতেও
স্রষ্ঠাকে অস্বীকার করার কোনো চেষ্টা নেই বরং পূজারী বা মোল্লা পুরুতরা ভজনালয়কে কুক্ষিগত
করায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘দেবতার স্থান’ কবিতার মতো প্রভুর কাছে নালিশ করা হয়েছে।
আশিটা বছর কেটে গেল, আমি
ডাকিনি তোমায় কভু।
আমার ক্ষুধার অন্ন তা’ বলে
বন্ধ করেনি প্রভু!
তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু তাই
মানুষের দাবী,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার
সকল দুয়ারে চাবি!
এখানে প্রভুকে দয়াময় রূপেই অঙ্কিত করা
হয়েছে, অস্বীকার করা হয়েছে পুরোহিততন্ত্রকে। ভজনালয়ে যত তালা দেওয়া দ্বার, সেগুলোকে
ভেঙে ফেলার আহ্বান জানালেও তিনি ভজনালয়কে ধ্বংস করতে চান নি, সব ভজনালয়ের দ্বার সকলের
জন্য খুলে দিতে চেয়েছেন,
কোথা চেঙ্গিস, গজনীর-মামুদ,
কোথা কালাপাহাড় ?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা
দেওয়া দ্বার !
এ কবিতার মুখ্য উদ্দেশ্য ধর্মের আনুষ্ঠানিকতার,
আচার সবর্স্বতার ভ-ামির মুখোশ উন্মোচন, ধর্মকে নাকচ করা নয়। নজরুলের প্রকৃত অভিযোগ,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভ- গাহে স্বার্থের জয়! অথবা যে মানুষ পৃথিবীতে গ্রন্থ কেতাব এনেছে
সেই মানুষকে অগ্রাহ্য করে, ঘৃণা করে, যারা কোরান, বেদ, বাইবেল পূজা করছে তাদের ভ- বলা।
ধর্ম প্রচারকদের এ কবিতায় মানুষরূপে বিবেচনা করে মানুষের অসীম সম্ভবনার প্রতি ইঙ্গিত
করা হয়েছে।
মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনছে প্রভু! গ্রন্থ
আনেনি মানুষ কোনো!
‘পাপ’কবিতায় পাপী-তাপী সবাইকে সাম্যের গান গেয়ে ভাই ও বোন
সম্বোধন করা হয়েছে। তেত্রিশ কোটি দেবতার পাপে স্বর্গ টলমল আর বিশ্ব এক পাপস্থান, অর্ধেক
এর ভগবান অর্ধেক এর শয়তান, এ দুনিয়া পাপশালা, এখানে সবাই পাপী অথচ আপন পাপের বাটখারা
দিয়ে আমরা অন্যের পাপ মাপি। সবাই যদি নিষ্পাপ বা দেবতা হতেন তাহলে পাপ পূণ্য নিয়ে এক
জবাবদিহির কোন প্রয়োজন হত না, টুপি পরে টিকি রেখে পাপ ঢাকার চেষ্টাই চলছে। সুন্দর চির
যৌবনা বসুমতির দেবতা কাম রতি, শিব নয়। এখানে এক আঁখির ইশারায় লক্ষ যুগের মহা তাপস্যা
উবে যায়, স্বর্গের দূতেরও সংযম বাঁধ, কারণের
বেড়া এখানে এসে টুটে যায়, শব্দ-গন্ধ-বর্ণময় এ পৃথিবীতে যে ফাঁদ পাতা তা থেকে
ফেরেশতারাও রেহাই পান না।
‘চোর ডাকাত’ কবিতায় বিশ্ব চৌর্য ও দস্যুবৃত্তির তথা শোষণের এক জীবন্ত
চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, ছোটদের সব চুরি করে বড়রা বড় হয়েছে। যারা যত বড় ডাকাত দস্যু জোচ্চোরদাগাবাজ
তারাই জাতিসংঘের তত বড় সম্মানী ও গুণী। প্রজার জমাট রক্ত ইটে রাজার প্রাসাদ উঠেছে,
কোটি মানুষের ভিটে নাশ করে ধনীর কারখানা চলে। বিপন্নদের অন্ন ঠেসে মহাজন-ভুঁড়ি ফুলছে,
নিরন্নদের ভিটে নাশ করে জমিদার জুড়ি গাড়ি চড়ছেন। এই কবিতায় ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়
শোষণের এবং মানব সভ্যতার এক দেউলিয়া রূপ তুলে ধরা হয়েছে।
পেতেছে বিশ্বে বণিক-বৈশ্য
অর্থ-বৈশ্যালয়,
নীচে সেথা পাপ-শয়তান-সাকী,
গাহে যক্ষের জয়!
‘ বারাঙ্গনা’ কবিতায়
বারাঙ্গনাদের প্রতি সহানুভূতির ও শ্রদ্ধা প্রকাশিত কারণ তারা মাতা ভগিনীরই জাতি। বারাঙ্গনাদের
প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনকে যুক্তি নির্ভর করার জন্য এ কবিতায় ইতিহাস ও পুরাণ থেকে কিছু
উদাহরণ উদ্ধৃত করে দেখানো হয়েছে, বারাঙ্গনা পুত্ররাও শ্রেষ্ঠ মানবের খ্যাতি লাভ করেছেন।
এ কবিতায় বৈশ্যাবৃত্তিকে ক্ষয়িষ্ণু সমাজ ব্যবস্থার ব্যাধি বা অভিশাপ রূপে চিত্রিত করা
হয় নি, বরং ঋষির দৃষ্টিতে বারাঙ্গনাদের প্রতি সহানুভূতি ও সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে,
এ কবিতায় সবচেয়ে বড় কথা...
অসতী মাতার পুত্র সে যদি
জারজ পুত্র হয়,
অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ
সুনিশ্চয়।
‘মিথ্যাবাদী’ কবিতায় ভীরু ও দুর্বল সত্যবাদী বা নীতিবিদদের চেয়ে
সেই সব মিথ্যাবাদীদের অধিক মূল্য দেওয়া হয়েছে যারা সত্যের জন্যে সহজেই জীবন বিসর্জন
দিতে সক্ষম। মুখে নয় প্রাণে সত্য নিষ্ঠা চাই,
সত্যবাদীরা ক’জন দিয়াছে
সত্যের তরে প্রাণ ?
অন্তরে যারা যত বেশি ভীরু
যত বেশি দুর্বল,
নীতিবিদ তারা তত বেশি করে
সত্য-কথন ছল !
নবকুমার চরিত্রের নোট পেতে ক্লিক করুন এখানে
‘নারী’ কবিতায় নারী জাতির প্রতি পরম শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন
করা হয়েছে। সামন্ত তান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারী পুরুষের সম মর্যাদা স্বীকৃত নয়, আধুনিক
কালেও মধ্যযুগীয় প্রথায় সে সমাজে নারীর স্থান নির্ধারিত। ‘নারী’ কবিতায়
নজরুল নারী জাতিকে পুরুষ জাতির সাথে সমান মর্যাদার আসন দান করার প্রয়াস পেয়েছেন।
বিশ্বে যা কিছু সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,
অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা কিছু এল পাপ-তাপ-বেদনা
অশ্রু বারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর অর্ধেক
তার নারী।
অথবা
এ বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল
ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ
সুনির্মল।
তাজমহলের পাথর দেখছ, দেখিয়াছ
তার প্রাণ?
অন্তরে তার মমতাজ নারী, বাহিরেতে
তার শাহজাহান।
‘রাজা-প্রজা’ কবিতায় সাম্যের গান গেয়ে, সমবেদনার সকল ভাই এক ধরণীর
সন্তান কেউ রাজা কেউ প্রজা, এই ব্যবস্থাকে অদ্ভুত দর্শন বলা হয়েছে প্রজা অন্যায়ের বিরুদ্ধে
প্রতিবাদ জানালে রাজ-বিদ্রোহী হয় অথচ রাজা অন্যায় করেও প্রজাদ্রোহী হয় না এই ব্যবস্থাকে
কবির কাছে অদ্ভুত মনে হয়েছে। প্রজারাই রাজা সৃষ্টি করেছে, রাজা তো আর প্রজা সৃষ্টি
করে নি অথচ যাদের নিয়ে রাজ্য তাদেরই রাজ্যের উপর কোনো দাবী নেই। তাই কবিতার শেষে আশা
করা হয়েছে,....
এ আশা মোদের দুরাশাও নয়,
সেদিন সুদূর নয়
সমবেত রাজকণ্ঠে যেদিন শুনিব
প্রজার জয়।
বাংলা সাহিত্যে সাম্যবাদের
প্রবক্তা কাজী নজরুল ইসলাম। হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত ও পথিকৃৎ কাজী নজরুল ইসলাম
বাংলা সাহিত্যে যে সাম্যবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতার ধারা সৃষ্টি করেছিলেন তা অভূতপূর্ব
ও অবিস্মরণীয়। তার তীব্র ও আপসহীন সাম্যবাদী চেতনা বিট্রিশ শাসিত পরাধীন ভারতবর্ষে
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মাঝেই ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনাসঞ্জাত
জাতীয় সংহতি ও একতা সঞ্চার ঘটিয়েছিল।