“সিন্দু হিল্লোল” কাব্যে গ্রন্থে নজরুলের বিরহতপ্ত প্রেমিক হৃদয়ের

 




প্রশ্নঃ- “সিন্দু হিল্লোল কাব্যে গ্রন্থে বিরহতপ্ত প্রেমিক হৃদয়ের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা তোমার নিজের ভাষায় লেখ।

 

প্রেম মানুষের একটি মৌল ও প্রবল অনুভূতি। তাই সর্বকালীন সাহিত্যে এর প্রাধান্য, নজরুল কাব্য এর ব্যাতিক্রম নয়। তার কাব্যে প্রেম একটি বিশিষ্ট স্থান লাভ করেছে। অথচ কৌতুকের বিষয় এই যে,বাঙালী পাঠকের নিকট তার প্রেমের কবিতা অপেক্ষা বিদ্রোহমূলক কবিতাই অধিকতর সমাদৃত। নজরুল পূর্বে বাংলা কবিতায় প্রেম ছিল নারীর কাঁদুনে বাহুল্যে ভরপুর। নজরুল প্রতিভা কাব্যের সেই একঘেয়েমি রূপ বদলে দিয়েছে। নজরুল কাব্যের প্রেম যেন পুরুষের প্রেম, নারীর প্রেম নয়। 

দোলন চাঁপার অনেক পরে নজরুলের আরেকটি কাব্যগ্রন্থ ‘সিন্ধু হিল্লোল (১৯২৭) প্রকাশিত হয়। প্রেমের কবিতায় নজরুল রবীন্দ্রনাথের মতো আদর্শ অমানবিক রহস্যময়ী, মানস সুন্দরী বা জীবন দেবীর উদ্দেশ্যে নিরুদ্দেশ যাত্রী নন, কিন্তু কোন আদর্শ প্রিয়াকে, অনামিকাকে কামনা করে বাসনার সীমিত গ-ির মতো পেতে ক্রন্দনরত, চিরবিরহী।

প্রেমের কবিতায় নজরুল রবীন্দ্রনাথের মতো আদর্শ অমানবিক রহস্যময়ী, মানস সুন্দরী বা জীবন দেবীর উদ্দেশ্যে নিরুদ্দেশ যাত্রী নন, কিন্তু কোনো আদর্শ প্রিয়াকে, অনামিকাকে কামনা বাসনার সীমিত গ-ির মধ্যে পেতে ক্রন্দনরত চিরবিরহী। এ যেন বৈষ্ণব কবির অপরূপকে রূপে প্রত্যক্ষ করার প্রয়াস, অসীমকে সীমার মধ্যে পাবার আকুলতা। ‘সিন্দু-হিল্লোল কাব্য গ্রন্থের ‘অ-নামিকা কবিতায় ঐ ব্যাকুলতা প্রত্যক্ষ করি। এ কবিতায় কবি এমন এক ‘স্বপ্ন সহচর ‘অনাগত প্রিয়ার বন্দনা করেছেন যে নারী ‘না পাওয়ার তৃষ্ণা জাগানিয়া। কবির এই ‘মানস রঙ্গিনী, ‘গোপনচারিণী, ‘চির প্রেয়সী, ‘বাসনা সঙ্গিনী, ‘অনন্ত যৌবনা বালা অর্থ্যাৎ উর্বশী। এই নারী অসীমা যে সীমার সম্পর্কে ধরা দেয় না। তাই কবির বেদনা,

অসীমা! এলে না তুমি সীমারেখা-পারে।

স্বপনে পাইয়া তোমা স্বপনে হারাই বারেবারে।

অরুপা লো! রতি হয়ে এলে মনে,

সতী হয়ে এলে নাক ঘরে।

এই সুদূরিকা ধরা দেয় না বলেই তাকে মনে হয়েছে মরীচিকা, জ্যোতি। জন্ম-জন্মান্তর, লোক-লোকান্তর ধরে, একই জন্মে শতবার করে ঐ সুদূরিকার আরতি করতে হয়। রূপে রূপে ঐ অপরূপাকে খুঁজে বেড়ালেও ঐ ব্যাথা দেওয়া রাণী, কথা কওয়া হয়ে ধরা দেয় নি। না পাওয়ার ঐ বেদনাই কবিকে করেছে উদ্বেলিত। নজরুলের প্রেম কবিতায় বিরহ রূপটি শান্ত নয়- চঞ্চল ও গতিময়, না পাওয়ার জন্য কেবল মানসিক বেদনা নয়, দৈহিক যন্ত্রনার প্রকাশ, কিন্তু সে বেদনা ও যন্ত্রনা সম্প্রসারিত গ্রহ-গ্রহান্তরে, লোক-লোকান্তরে, জন্ম-জন্মান্তরে।

তোমারে দেহের তীরে পাবার দুরাশা

গ্রহ হতে গ্রহান্তরে লয়ে যায় মোরে!

বাসনার বিপুল আগ্রহে-

জন্ম লভি লোকে-লোকান্তরে!

নজরুল কাব্যে সাম্যবাদী চেতনা এখানে

অ-নামিকা কবিতার উপসংহারে ‘যুগে যুগে না পাওয়ার তৃষ্ণা-জাগানিয়া কে অবলম্বন করে, প্রেমিকের আকাক্সক্ষার অপূর্ণতা থেকে সৃষ্ট চেতনা উপলব্ধি করেছেন, প্রেম সত্য চিরন্তন, প্রেমের পাত্র চিরন্তন নয়। তাছাড়া প্রেমের রহস্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন, “এই ধূলির ধরায় প্রেম ভালবাসা আলেয়ার আলো। সিক্ত হৃদয়ের জলাভূমিতে এর জন্ম।

....... আজ মনে হয়

প্রেম চিরন্তর সত্য,প্রেমের পাত্র সে বুঝি চিরন্তন নয়।

সিন্দু-হিল্লোল কাব্য গ্রন্থের ‘গোপন প্রিয়া কবিতায় প্রিয়া অনামিকা হলেও রহস্যময়ী বা মরীচিকা বা সুদূরিকা নয়। গোপন প্রিয়া কাছের হয়েও দুরের-কারণ ‘আমি এ-পার, তুমি ও-পার, মধ্যে কাঁদে বাধার পাথার। এ বাধার স্বরূপ কি? পরিচয়ের, চেনার, জানার অবকাশের অভাব,

নাম-শোনা দুই বন্ধু মোরা, হয় নি পরিচয়।

আমার বুকে কাঁদছে আশা, তোমার বুকে ভয়।

অথবা

চেনার বন্ধু, পেলাম না ক জানার অবসর।

গানের পাখি বসেছিলাম দুদিন শাখার পর।

নবকুমার চরিত্র পেতে ক্লিক করুন

এ কবিতায় কবি দুরের প্রিয়াকে কবি পান নি বলেই তাঁর ভালবাসা আজও অম্লান হয়ে আছে। মিলনে প্রেমের সঙ্কোচন, বিরহে সম্প্রসারণ। কবি বিরহে মুহ্যমান নন, কেননা তাঁর কাব্যে প্রিয়ার মূর্তি ধরা পড়েছে। তাঁর গান, কাব্য প্রভৃতি সবই প্রিয়ার প্রেমে একাকার। কোন কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা না করেই তিনি শুধু প্রেম দান করে যাবেন আজীবন।

শিল্পী আমি, আমি কবি,

তুমি আমার আঁকা ছবি,

আমার-লেখা কাব্য তুমি, আমার-রচা গান।

চাইব না ক, পরান ভরে করে যাব দান।

মাধবী-প্রলাপের মধ্যেও ভোগন্মুখ, জীবনোৎসুক ও কামানাতুর প্রেমের নিবিড় সান্নিধ্য উপলব্ধি করা যায়। বসন্তের আগমনে কবি প্রকৃতির মধ্যে সুতীব্র সম্ভোগতৃষ্ণার বিচিত্র প্রকাশ লক্ষ্য করে তার যে বর্ণবহুল চিত্র এঁকেছেন তাতে তাঁর সুতীব্র দেহাত্মক প্রেমানুভূতি ও জীবনাসক্তি ব্যক্ত হয়ে। মানবিক প্রেমেসম্ভোগোর প্রবল পিপাসা থেকেই কবি লেখেন,-

আজ  লালসা-অলস-মদে বিবশা রতি

শুয়ে     অপরাজিতায় ধনী স্মরিছে পতি।

তার নিধুবন উন্মন,

ঠোঁটে কাঁপে চুম্বন,

বুকে পীন যৌবন

উঠেছে ফুঁড়ি,

মুখে     কাম-কন্টক-বন মহুয়া-কুঁড়ি।

দেহগত প্রেমের এ তীব্রতা Ben Jonson, Robert Herrick, Robert Burns, Jhon Keats প্রমুখ কবির কথা মনে করিয়ে দেয়।

Burns প্রেমের সৌন্দর্য ও মাধুর্যে আত্মহারা।

“O my Luve’s like red a red rose

That’s newly sprung in June:

O my Luve’s like the melodie

That’s sweetly play’d in tune.

এ কাব্য গ্রন্থের ‘সিন্ধু কবিতাত্রয়ীর প্রথম তরঙ্গে সমুদ্রকে বন্ধু, চির বিরহী ও অতৃপ্ত রূপে সম্বোধন করেছেন অর্থ্যাৎ আপন চিত্তের প্রতিফলন তিনি সাগরের অশ্রান্ত কল্লোল ও গর্জনের মধ্যে অবলোকন করেছেন, সাগরের সঙ্গে আপন অশান্ত প্রকৃতির সাদৃশ্য কল্পনা নজরুলের ‘সিন্ধু কবিতার মূল আবেগ,

হে সিন্ধু, হে বন্ধু, হে চির বিরহী!

হে অতৃপ্ত! রহিরহি

কোন বেদনায়

উদ্বেলিয়া ওঠ তুমি কানায় কানায়?

জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুচেতনা এখানে

সমুদ্রের অশান্ত কল্লোল নজরুলের কাছে দিবারাত্রির অনন্ত ক্রন্দন রূপে প্রতিভাত আর সমুদ্রের এই ক্রন্দনের মূলে নজরুল সন্ধান পেয়েছেন বেদনার, সে বেদনা হারাবার বেদনা, বিচ্ছেদের বেদনা। সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার সঙ্গে চাঁদের যে সম্পর্ক সেই সূত্রে সুদূরের চাঁদকে সমুদ্রের প্রেয়সী কল্পনা এবং তাঁদের বিচ্ছেদের জন্যই সমুদ্রের গান আর ক্রন্দন,

ঐ চাঁদ ঐ সে কি প্রেয়সী তোমার?

ও কি গান? ও কি কাঁদা? ঐ মত্ত জলে ছলছল

ও কি হুঙ্কার?

ঐ চাঁদ ঐ সে কি প্রেয়সী তোমার?

টানিয়া সে মেঘের আড়াল

সুদূরিকা সুদূরেই থাকে চিরকাল?

নজরুলের প্রেমের কবিতায় প্রেমিকের যে বিরহী, অভিমানী, অতৃপ্ত ও ক্ষুধার্ত রূপ দেখি প্রমত্ত সাগরকে তারই প্রতিমূর্তি করে তুলেছেন নজরুল। সমুদ্র কল্পিত হয়েছে এক অনন্ত পুরুষ রূপে, আজকের এই অশান্ত পুরুষ একদিন প্রশান্ত ছিল, সেদিন তার বক্ষ তরঙ্গায়িত ছিল না, সেদিন তার রূপ ছিল বিপুল আরশির মতো স্থির, শান্ত, সচ্ছ, তারপরে চন্দ্রের উদয় হল, সৃষ্টি হল বেদনার।

তারপর চাঁদ এলো-কবে, নাহি জানি।

তুমি যেন উঠলে শিহরি

হে মৌনী কহিলে কথা “মরি মরি,

সুন্দর সুন্দর

কবি কদাচ অতিন্দ্রীয় লোকের অভিযাত্রী নন। ‘ফাল্গুনী কবিতায় চারিদিকে প্রকৃতির মধ্যে বসন্তের মিলোনোৎসব  নারীর অতৃপ্ত ব্যথা প্রকাশিত হয়েছে। নারীর উক্তি.....

বল   কেমনে নিবাই সখি বুকের আগুন!

এল      খুন মাথা তুন নিয়ে খুনেরা ফাগুন।

চাঁদনী রাতে কবিতায় চন্দ্রালোকিত প্রকৃতির আশ্চর্য সুন্দর প্রেমরূপ বিশেষ নৈপুণ্যের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। কবি চাঁদনী রাতে প্রকৃতির মধ্যে বিরহ ও মিলনের লীলা প্রত্যক্ষ করেছেন।

নিখিল বিরহী ফরিয়াদ করে আমার বুকের মাঝে,

আকাশে বাতাসে তাদেরি মিলন তাদেরি বিরহ বাজে।

বধূ-বরণ কবিতাটিতে কবি নারীত্বের নবজাগরণ চেয়েছেন। বিবাহের রঙিন স্বপ্নে জীবনে রঙিন রয়ে ওঠে। এরকম রঙিনতার মধ্যে নবজীবনের উদ্বোধন হোক, এই কবির একান্ত কামনা। বিবাহিত প্রেমের যে রূপ তিনি চিত্রিত করেছেন তার মধ্যে নারীর স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদার বাণী উচ্চারিত।.....

বিরহের রঙে রাঙা আজ সব,

রাঙা মন রাঙা আভরণ,

বল নারী- এই রক্ত আলোকে

আজ মম নবজাগরণ।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন