রবীন্দ্র ছোটগল্পে সমাজ ও মানুষ অতি জীবন্ত ও বাস্তব
সাধারণভাবে
কোন সাহিত্যেকের পক্ষে সমকালীন রুচি বা জীবনকে একেবারেই অসম্ভব। আর তাই প্রতক্ষ্য বা
পরোক্ষ ভাবে সাহিত্যে বিষয়বস্তু , উপকরণ উপাদান হিসেবে সাহিত্যে সমকালীন সমাজ জীবন
প্রোতিথ হয়। রবীন্দ্র ছোটগল্পও এর ব্যাতিক্রম নয়। দেশ-কাল-সমাজ এমনকি সাধারণ মানুষ
থেকে শুরু করে সকল শ্রেণীর জীবন চিত্র তাঁর গল্পগুচ্ছে অঙ্কিত হয়েছে। নিন্মে গল্পগুচ্ছের
বিশেষ বিশেষ গল্পের আলোকে সমাজ ও মানুষে বাস্তব জীবন্ত চিত্র আলোচনা করার প্রয়াস পাব।
মানুষ ও সমাজ পরস্পর পরিপূরক। মানুষহীন সমাজ
বা সমাজহীন মানুষ অস্তিত্ব অকল্পনীয়। আর তাই মানুষ ও সমাজ অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত। সমাজ
শ্রেণী চরিত্র দ্বারা গঠিত বা নির্মিত। সমাজ হল বিভিন্ন পেশা ও বৃত্তির মানুষের সম্বনিত্ব
রূপ। আর রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন গল্পে তার সমাজ ও মানুষের স্বরূপকে জীবন্ত করে অঙ্কিত
করেছেন।
গল্পগুচ্ছের একটি অসামান্য ছোটগল্প হল “শাস্তি”। এই গল্পে রবীন্দ্রনাথ অন্তজ মজুর শ্রেনীর চরিত্র আলেখ্য যেমন
নির্মাণ করেছেন তেমনি সমকালীন সমাজ ব্যবস্থায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও আইন ব্যবস্থার অসারতাকে
সহজ সরল ভাষায় তুলে ধরেছেন। এই গল্পে রবীন্দ্রনাথ বাঙালী পারিবারিক জীবনের এমন এক নিন্মস্তর
থেকে কাহিনী সংগ্রহ করেছেন যেটি আজকের কোন লেখকের জন্য শ্লাঘার হতে পারে।
ছিদাম রুই ও দুখি রাম রুই দুই ভাই। তারা
দিন আনে দিন খায়। ঘরে রয়েছে তাদের দুই স্ত্রী। দুই স্ত্রীর মধ্যে সারাক্ষণ কহল বিবাদ
লেগে থাকে। ঘটনার দিন লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই, সেদিন চারিদিকে মেঘ জমে ছিল দুই
প্রহরের সময় খুব এক পশলা বৃষ্টিও হয়েছিল। বাতাসের লেশ মাত্র ছিল না। দুখিরাম ও খুদিরাম
সেদিন জমিদারের কাছারি ঘরে কাজ করতে গিয়েছিল। সারাদিন খাটা খাটনির পরও তাদের প্রাপ্য
মুজুরি ই তো পাই নি বরং অনেক অন্যায় ও কটু কথা তাদের হজম করতে হয়েছে। ক্ষুধায় ক্লান্তিতে
সন্ধ্যা বেলায় ঘরে ফিরে এসে দেখে চাল ছিল না বলে ভাত হয় নি। সংবাদ তার স্ত্রী অনেক
ঝাঝালো সুরে জানাতেই দুখি রামের মাথায় খুন চেপে যায় এবং হাতের পাশে থাকা দা উঠিয়ে তার
বউকে আঘাত করে ফলে তার স্ত্রীর মৃত্যু ঘটে। রামকানাইয়ের পরামর্শে যখন ছিদাম থানায় গিয়ে
ঘটনাটি খুলে বলে তখন ছিদামের কণ্ঠে আমরা শুনতে পাই “বউ গেলে বউ পাওয়া যায় কিন্তু ভাই
গেলে ভাই পাওয়া যায় না।” এই উক্তিটির মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ
তৎকালীন সমাজে নারীর অবমূল্যায়ন কতটা প্রখর ছিল তা স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরেছেন।
অতপর আদালতের কাঠগড়ায় চন্দরাকে দাড় করানো হল এবং
জা হত্যার সমস্ত দায় চন্দরার উপর চাপিয়ে বিজ্ঞ আদালত তাকে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত করল।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ পুলিশি ব্যবস্থা, আইন ব্যবস্থার অসারতা ফুটিয়ে তুলেছেন।
দুটি অসম স্তরের নর নারী হৃদয়ের সম্পর্ক
রহস্যকে শিল্পী উপলব্ধি করতে চেয়েছেন “পোস্ট মাস্টার” গল্পে। রতন সমাজের যে স্তর থেকে
উদ্ভুত পোস্ট মাস্টারের সামাজিক স্তর তা থেকে অনেক উর্দ্ধে। পৃথিবীতে আমরা যাকে ভালবাসি
এবং যা কিছু কে ভালবাসি সবই যেন পেতে না পেতেই পাওয়ার আবর্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। শ্রেয়ের
জন্য প্রেয়ের জন্য আমাদের আত্মার নিরন্তন আকূতি কেবই কান্নায় পর্যবসিত হচ্ছে - পোষ্ট
মাষ্টার কেবলই সেই কান্নার ইতিহাস।
গল্পের শেষে বর্ষা বিষ্ফরিত নদী উচ্ছলিত
অশ্রু রাশির মত ছল ছল“ করে উঠেছে এবং মিথ্যার আশাকে দুই
বাহু পাশে বাধিয়া বুকের ভেতরে প্রাণ পনে জড়িয়ে ধরে পোষ্ট অফিসের গৃহের চারদিকে কেবল
অশ্রু জলে ভাসিয়া ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছে। রতনের এই অশ্রু জলের পেছনে বাস্তবের কোন সামাজিক
অথবা সাংসারিক ব্যাপার ছিল না। এখানে সমস্ত বেদনার উৎস কেন্দ্র হৃদয় রহস্যের গভীরে
প্রোথিত।
ছুটি গল্পটিকে পোষ্টমাষ্টার গল্পের বিপরীত
গল্প বা পরিপূরক হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। পোষ্টমাষ্টার
গল্পে লেখক দেখিয়েছেন জলের মাছকে ডাঙ্গায় তুললে যে অবস্থা হয় তেমনি হয় শহুরে প্রাণ
পল্লীতে এলে। ছুটি গল্পে ঠিক তেমনি দেখিয়েছেন পল্লী হৃদয়কে শহরে এনে। নাগরিক জীবনের
সান্নিধ্যে আসার পর ফটিকের হৃদয় বেদনার যে চিত্র আমরা গল্পটিতে পাই সেটাই এ গল্পের
মধ্যে সর্বাপেক্ষা সর্বাপেক্ষা মর্মন্তিক।
সমকালীন
সমাজ ও যুগ মানুষে সমৃদ্ধ গল্প ‘মেঘ ও রৌদ্র’। শশীভূষণের
চরিত্রের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশের শান্ত স্নিগ্ধ জীবন এবং ইংরেজ শাসিত ও উপনিবেশের
সভ্যতা ও বর্বরতা সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। শশীভূষণ পুলিশের গায়ে হাত দিয়ে শাস্তি পায়
এবং ইংরেজদের ধন্যা দিয়েও অপমানিত হয়। প্রকৃত অর্র্থে সকল দিক দিয়ে ইংরেজদের উৎকট অত্যাচারে
জর্জরিত ছিল তৎকালীন সমাজ।
যুক্তিহীন অন্ধ কুস্কংকার মানব মনে অসম্ভবকে
সম্ভব করে তোলে তার নির্দশন জীবিত ও মৃত। জীবিত ও মৃত গল্পে কাদ্মবীনি কতগুলি অন্ধ
কুসংষ্কারে বেষ্টনীতে আবদ্ধ হয়ে প্রতক্ষ জীবনকেও সত্য বলে মেনে নিতে পারছিল না। শশ্মানে
গিয়ে আবার যে কাদ্মবীনি বেচে উঠল সেটা কোন ভৌতিক মায়া মরীচিকার ব্যাপার নয়, প্রতক্ষ
সত্য। কিন্তু হলে হবে কি? ঐ যে একটা কুসংষ্কার আছে মানুষ মরে ভুত হয়ে। সে কুসংষ্কারের
প্রভাবে জগৎ সংসারে কোথাও কদ্মবীনিকে প্রত্যক্ষ দেখেও মানুষ রুপে কেউ ভাবতে পারে নি।
কাদ্মবীনি নিজেও ভাবিয়াছে“আমিতো বাচিয়া নাই। জীবরাজ্য হইতে আমি
যে নির্বাসিত হইয়াছি- আমি যে আমার প্রেত্মাতা”। এভাবে
রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন বিশ্বাস, ঐতিহ্য,ইতিহাসকে আশ্রয় করে সমাজ ও মানুষকে জীবন্ত করে
ফুটিয়ে তুলেছেন।
‘হালদার গোষ্ঠী ও হৈমন্তী’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ একই সমস্যাকে দুই দিক থেকে দেখেছেন। মধ্যযুগীয়
চেতনায় উজ্জীবিত একজন পুরুষ কীভাবে দুঃসহ অবস্থায় পতিত হয়। তার চিত্র ‘হালদার গোষ্ঠী’ গল্পে এবং সে ব্যক্তিটি নারী হলে তার কি অবস্থা দাড়ায় তার
চিত্র হৈমন্তী গল্পে। বানোয়ারী লাল পুরুষ বলে জীবনের মধ্যে মুক্তির পথ সে খুঁজে নিতে
পারে কিন্তু নারী হৈমন্তীর মুক্তি মৃত্যুতে।
নর-নারীর অসামাজিক প্রেমান্বয়ে হৃদয়ানুভূতির
অনুধাবন ‘নষ্টনীড়’ গল্পে চিত্রিত হয়েছে। এ গল্পে ছোট
ছোট ঘটনার ম্যধ দিয়ে চারুলতা তার অজান্তে অমলের প্রতি আকৃষ্ট হয়। অসামাজিক প্রেমের
নিটল চিত্র এটি।
‘বিচারক ও প্রায়শ্চিত্ত’ গল্পে রবীন্দ্রনাথের সমাজ বীক্ষণ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রকাশ
পেয়েছে। বিভিন্ন বিধি নিষেধ, আচার সর্বসত্তা কীভাবে হিন্দু সমাজে আস্টে পিষ্ঠে জড়িয়ে
আছে তার উজ্জল দৃষ্টান্ত বিচারক ও প্রায়শ্চিত্ত গল্প দুটি।
পরিশেষে বলা যায় যে, এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায়
নেই যে, অণুবিশ্বের সঙ্গে মহাবিশ্বের সম্মিলন রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে যতটা সার্থক হয়েছে
তা আর অন্য কোথাও হয় নি। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প যেন নখদর্পনে বিশ্ব দেখা। ঈশ্বরের সৃষ্টিকে
কোন পুনরুক্তি নেই, ছোটগল্পের রবীন্দ্রনাথ যেন ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী।