কালকেতু উপখ্যান অবলম্বনে মুকুন্দরামের সমাজ সচেতনতা লিখ।

 




প্রশ্নঃ- কালকেতু উপাখ্যান অবলম্বনে তৎকালীন সমাজ চিত্র অংকনে মুকুন্দরামের সাফল্য আলোচনা কর।

সাহিত্যের প্রয়োজনে জীবন নয়, বরং জীবনের প্রয়োজনে সাহিত্য। সাহিত্য মানেই জীবন। সাহিত্য বৃত্তহীন পুষ্পের ন্যায় আপনা আপনি ফুটে উঠে না। বিশেষ কাল, দেশ এবং তার অধীনের মানুষকে নিয়েই সাহিত্যের উদ্ভব। সামাজিক জীবনের মূল্যবোধ ও যুগ চেতনাকে সুন্দর ভাবে  রূপ দেওয়াই কবি - সাহিত্যিকদের ধর্ম। সাহিত্যের মাধ্যমেই যুগ চেতনা মূর্ত হয়ে উঠে। সুতারাং প্রায় সাহিত্যে অল্প বিস্তর সমকালীন সমাজের চিহ্ন ও চিত্র পাওয়া যায়। কোন সাহিত্যে তা প্রত্যক্ষ ভাবে আবার কোনটিতে পরোক্ষ ভাবে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এর ব্যাতিক্রম ঘটে নি।

 

ষোড়শ শতাব্দীর কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের ‘কালকেতু’ উপাখ্যানে দেব দেবী নির্ভর কাব্য রচনা করতে গিয়েও মধ্যযুগের যে সমাজ চিত্র অংকন করেছেন তা ঐতিহাসিকদের নিকট চিরকাল অমূল্য বিবেচিত হবে। এই কাব্য রচনায় কবি যে শৈল্পিক অনুভূতি, কাহিনী নির্মাণ, চরিত্র চিত্রন এবং বাস্তব জীবনের রস সৃষ্টিতে যে নিপুণতা দেখিয়েছেন তা আধুনিক কালেও বিরল। নিন্মে কালকেতু উপাখ্যানের সমাজ চিত্র তুলে ধরা হল।


ক. জমিদারদের অত্যাচরের চিত্র:  মুকুন্দরাম ছিলেন ষোড়শ শতকের কবি। ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলাদেশের সমাজ জীবনের একটি ছবি ধরা পড়েছিল তার কাব্যে। মুকুন্দরাম ছিলেন গ্রাম্য জীবনের কবি। তাই তার কাব্যে গ্রামীণ পরিবেশ ও মানুষের জীবন রূপ ধরা পড়েছে। গ্রন্থ উৎপত্তির কারণ বর্ণনা অংশে কবি সেকালের জমিদারের অত্যাচারের একটি রূপ চিত্র অংকন করেছেন। ডিহিদার মাসুদ শরীফের অত্যাচারে কবি পৈত্রিক ভিটা ছেড়ে অন্য রাজ্যে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। মাসুদ শরীফের জমিদারিতে প্রজার দুর্দশা বর্ণনা করতে গিয়ে কবি বলেন ....

 

সরকারে হৈল কাল    খীল ভূমি লেখে লাল

বিনি উপকারে খায় ধুতি

পোতাদার হৈল যম    টাকা আড়াই আনা কম

পায় লভ্য খায় দিন প্রতি।

 

          খ. তৎকালীন ব্যাধ সমাজের আচার-আচরণ:   কালকেতু উপাখ্যানে সমাজ জীবনের যে চিত্র পাওয়া যায় তা গ্রাম ভিত্তিক। গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবন তার কাব্যে নিখুত ভাবে ধরা পড়েছে। বিশেষ করে ব্যাধ সমাজের জীবন যাত্রা ও আচার আচরণ সম্পর্কে কবির যে বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল নিদয়ার গর্ভ, সাধ ভক্ষণ, কালকেতুর জন্ম, বিবাহ প্রবৃতি বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়। গর্ভবতী মেয়েদের খাবারের প্রতি অরুচি এবং বিশেষ কিছু খাবারের প্রতি আগ্রহ সর্ম্পকে কবি একটি নিখুত বর্ণনা দিয়েছেন। ...

 

যদি পাই মিঠা ঘোল    পাকা চালিতার ঝোল

প্রাণ পাইলে হয় আমসী।।

আমার সাধের সীমা    হেলঞ্চ কলসী গিমা

বোয়ালী কুটিয়া কর পাক।।

 

সেকালের বাঙালী খাদ্যের কবি যে বর্ণনা দিয়েছেন তা আজকের যুগের কাব্যেও দুর্লভ। এরপর কালকেতুর জন্মাংশে প্রসূতির গর্ভ বেদনা, তৎকালীন সময়ে তার মানসিক অবস্থা, সখীদের সান্ত্বনা বাক্য, স্বামীর চিন্তিত মুখ প্রভৃতি বিষয়ে কবি বর্ণনা বাস্তব ও জীবন্ত। কালকেতুর জন্মের পর পিতা ধর্মকেতুর øান সমাপন শেষে ব্রাহ্মণদের দান দক্ষিণা, নবজাতকের নাম রাখা ইত্যাদি বিষয়ে নিখুত বর্ণনা পাওয়া যায়।


          গ. তৎকালীন সমাজে বিবাহ: কালকেতুর বিবাহ অংশে ব্যাধ সমাজের বিয়ের আচার অনুষ্ঠান সর্ম্পকে যে বর্ণনা দিয়েছেন তা দ্বারা কবির পর্যবেক্ষণ শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। ফুল্লরার সাহিত কালকেতুর দাম্পত্য জীবনের নানা খুটি নাটি বর্ণনার মধ্যে দিয়ে তৎকালীন গ্রামীণ মানুষের বিশেষ করে ব্যাধ সমাজের একটি ছবি নিখুত ভাবে তুলে ধরেছেন মুকুন্দরাম। ফুল্লরা তার অভাবের সংসারে স্বামীর আহারের জন্য অনেক  কষ্ট স্বীকার করেছেন। কিন্তু যেদিন তার গৃহে এক সুন্দরীর আর্বিভাব ঘটেছে সেদিন ফুল্লরা বলেছে তার সুখের সংসারে আগুন লাগতে বসেছে। ফুল্লরা যুবতীকে জিজ্ঞাসা করে কেন সে স্বামীর সংসার ছেড়ে এসেেছ। যুবতী সতীনের গঞ্জনার কথা উল্লেখ করলে ফুল্লরা তাকে পরামর্শ দিয়েছে ....

সতিনী কন্দল করে    দ্বিগুণ বলিবে তারে

অভিমানে ছাড় কেনি। 

এসব উপদেশ দেওয়ার পেছনে ফুল্লরার যে উদ্দেশ্য কাজ করেছে, তা হল যুবতীকে তার সংসার থেকে তাড়িয়ে দেওয়া। এজন্য সে তার বার মাসের দুঃখ বর্ণনা করেছে। এসব অংশের মধ্যে দিয়ে তৎকালীন সমাজ জীবনের সঙ্গে সংসার জীবনের জ্বালা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

          ঘ. তৎকালীন সমাজের ঠকবাজ শ্রেণির কথা: ষোড়শ শতাব্দীর বাংলাদেশে গ্রামীণ মহাজন ও সুদখোরদের এক জীবন্ত রূপ দিয়েছেন মুকুন্দরাম মুরারী শীল চরিত্রের মধ্যে দিয়ে। মুরারী শীল বেনে। টাকা ধার দেওয়া, সুদ সহ আদায় করা এবং মানুষ ঠকানো তার কাজ। এই মুরারী শীলের কাছে কালকেতু দেবী প্রদত্ত আংটি ভাঙ্গাতে গেলে মুরারী শীল ভেবেছে কালকেতু বুঝি ধার চাইতে  এসেছে। তখন সে আত্মগোপন করেছে এবং তার স্ত্রীকে পাঠিয়েছে। তার স্ত্রী বলেছে ....

প্রভাতে তোমার খুড়া    ঘিয়াছে খাতক পাড়া

কালি দিব মাংসের উধার।।

পাওনাদারকে বিদায় করার এটা একটা কৌশল। কিন্তু কালকেতু যখন বলে যে ধার চাইতে আসে নি, একটি আংটি ভাঙ্গাতে এসছে। তখন মুরারী শীল অর্থের লোভের আশায় ঘরের খিড়কী পথে কালকেতুর সামনে উপস্থিত হয়। এবং কালকেতুর হাত থেকে সে আংটি নিয়ে আপন মনোভাব গোপন করে বলে ...

সোনা রূপা নহে বাপা এ বেঙ্গা পিতল।

ঘসিয়া মাজিয়া বাপু করেছে উজ্জ্বল।।

          ঙ. কলহ প্রিয়তা ও পরনিন্দার চিত্র:  সে সময়কার লোকের কলহ প্রিয়তা ও পরনিন্দা করার স্বভাব কোন অংশেই কম ছিল না। ভাড়– দত্ত যেভাবে কালকেতুর নিন্দা করেছে তা সত্যিই বাস্তব সমাজের পরনিন্দার চেয়ে কম নয়। ...

তিন গোটা শর ছিল    এক গোট বাঁশ

হাটে হাটে ফুল্লরার পসরা দিত মাস।।

এতেক নিষ্ঠুর বলে    আমার কপাল

তুমি ধনমন্ত এবে আমি সে কাঙ্গাল।।


          চ. তৎকালীন সমাজে জাতির কথা: দেশ জাতিভেদে প্রথা সে সময়ের সমাজে বিশেষভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। কালকেতুর নব প্রতিষ্ঠিত গুজরাট সমাজে বিভিন্ন প্রজার মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন জাতির পরিচয় সর্ম্পকে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, ধীবর, গোপ, মুসলমান প্রভৃতি জাতি সেখানে বাস করত। বিশেষ করে মুসলমান সমাজ জীবনের কথা বর্ণনার কোথাও তিক্ততা ফুটে ওঠে নি। ডিহিদার মাসুদ শরীফের দ্বারা অত্যাচারিত হলেও কবি তার কাব্যে সাম্প্রদায়িকতাকে স্থান দেন নি। তাদের জীবন যাত্রা তিনি বাস্তবতার ভিত্তিতে সহৃদয়তার সঙ্গে অংকিত করেছেন। মূলত সেখানে সকল জাতি সৌহার্দের সাথে বাস করত।

          ছ. বাণিজ্যের বর্ণনা: কালকেতু উপাখ্যানের মধ্যে আমরা সেকালের বাণিজ্যের বর্ণনা পাই। সিংহল রাজ্যের দরবারে উপস্থিত হয়ে বলেছেন - তুরঙ্গ, নারকেল, পায়রা, গাছফল, পাটশন, কাষ্ট, লবণ প্রভৃতি দ্রব্যের পরিবর্তে জয়ফল, গুয়া, শ্বেত, চামল, নীলা, তাড়া. চন্দন, মুক্তা তার চাই।

          জ. তৎকালীন সমাজের যুদ্ধ বিগ্রহ: মুকুন্দরাম চক্রবর্তী সেকালের যুদ্ধ বিগ্রহের বিবিধ বর্ণনা দিয়েছেন। কালকেতুর সাথে বিভিন্ন পশুর যুদ্ধ বিগ্রহের বিশদ বিবরণ আমরা পেয়ে থাকি। তেমনি আমরা পেয়ে থাকি কালিঙ্গরাজ্যের সাথে যুদ্ধের বর্ণনা। কালকেতুর যুদ্ধ সজ্জায় আমরা সেকালের যুদ্ধের এক নিপূণ চিত্র পাই।

    ঝ. সমাজের উচুঁ নিচুর বৈষম্য চিত্র: তৎকালীন সমাজে উচু নিচুর প্রবল বৈষম্য ছিল। তথাকথিত নিচু শ্রেনীর লোকেরা অতি দুঃখে জীবন যাপন করত। ফুল্লরার বারসাস্যার ভেতর দিয়ে দরিদ্র শ্রেনীর জীবন যাত্রার চিত্রফুটে উঠেছে। দরিদ্র নারীর সম্বল ছিল মেটো পাথর আর বাসী পান্তা। তারা অন্যের ধান ভানতো, হাটে চরকাকাটা সুতা বেচত, ছেড়া খানি খুঞা পারত এবং অন্যের কুড়েতে থাকত।

    উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা বলতে পারি যে, কবি তার কাব্যের মাধ্যমে লৌকিক জীবনকে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কাব্যের পৌরাণিক কাঠামোর মধ্যে তিনি অত্যন্ত সার্থকতার সঙ্গে সমাজের সাধারণ নর - নারীর দুঃখকে নিপূণ হাতে তুল ধরতে সক্ষম হয়েছেন।                           

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন