আঠারো বছর বয়স কবিতার ব্যাখ্যা ও মূলভাব
১. সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯২৬ সালের ১৫ ই আগস্ট।
২. তার পৈতিৃক নিবাস গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া।
৩. তার পিতার নাম নিবারণ চন্দ্র ভট্টাচার্য, মায়ের নাম সুনীতি দেবী।
৪. ছোটবেলা থেকেই সুকান্ত ছিলেন অত্যন্ত রাজনীতি-সচেতন।
৫. তিনি ‘ দৈনিক স্বাধীনতা’র কিশোরসভা অংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এর সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন।
৭. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে কবিতা মুক্তিকামী বাঙালির মনে বিশেষ শক্তি ও সাহস যুগিয়েছিল।
৮. ১৯৪৭ সালের ১৩ই মে মাত্র একুশ বছর বয়সে প্রকিভাবান এ কবির অকালমৃত্যু হয়।
- এ বয়স থরো থরো কাঁপে- বেদনায়।
- এ বয়সে কানে আসে- কত যন্ত্রণা।
- এ দেশের বুকে আসুক নেমে- আঠারো
- ফ্যাসিবাদী বিরোধী লেখক শিল্পীদের পক্ষে আকাল কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেছিলেন।
- পদাঘাতে ভাঙতে চায়- পাথার বাধা।
- আঠারো বছর বয়স জানে না- কাঁদতে।
- আঠারো বছর বয়স জানে- রক্তদিতে।
- মানবজীবনের এত উত্তরকালীণ পর্যায়- আঠারো বছর বয়স।
- ‘ছাড়পত্র’ তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ।
- তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ- ঘুমনেই, পূর্বাভাস।
- অনতান্য রচনা- ‘মিঠেকড়া’, ‘অভিযান’, হরতাল
ইত্যাদি।
- তিনি ফ্যাসিবাদীবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের
পক্ষে ‘আকাল’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন।
- লাইন-৩২টি, স্তবক-৮টি, আঠারো-৯বার, আঠারো বছর বয়স-৭ বার।
- মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত কবিতাটিতে প্রতি চরণে মাত্রা সংখ্যা ১৪টি।
- প্রতি চরণে মাত্রাবিণ্যাস- ৬+৬+২
- মনে রাখার উপায়ঃ- হরতালের পূর্বাভাস পেয়ে চোখে ঘুম নেই। তাই মিঠে কড়া করে চা খেয়ে ছাড়পত্রের অভিযানে নামলে তার আকাল মৃত্যু হয়।
সোনার তরী কবিতার মূলভাব এখানে
উৎস ও পরিচিতি: সুকান্ত
ভট্টাচার্যের ‘আঠারো বছর বয়স' কবিতাটি ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ছাড়পত্র’
কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে। মাত্র একুশ বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছিল সুকান্তের।
ধারণা করা হয়, আঠার বছর বয়সে পদার্পণের আগেই কিংবা আঠার বছর বয়সে কবি এই
কবিতাটি রচনা করেছিলেন। এই কবিতায় কবি
নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বয়ঃসন্ধিকালের বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছেন। কৈশোর থেকে যৌবনে
পদার্পণের এই বয়সটি উত্তেজনার প্রবল আবেগ ও উচ্ছাসে জীবনের ঝুঁকি নেবার। এ বয়স
অদম্য দুঃসাহসে সকল বাধা-বিপদকে পেরিয়ে যাওয়ার এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু
করে দাঁড়াবার ।।
এ বয়সের ধর্মই হল আত্মত্যাগের মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়া,
আঘাত-সংঘাতের। মধ্যে রক্ত-শপথ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। পাশাপাশি সমাজজীবনের নানা
বিকার, অসুস্থতা ও সর্বনাশের অভিঘাতে এ বয়স আবার হয়ে উঠতে পারে ভয়ংকর। বিকৃতি ও
বিপর্যয়ের অজস্র আঘাতে ক্ষতবিক্ষত ও নিঃশেষিত হতে পারে সহস্র প্রাণ।
কিন্তু অদম্য এই বয়সের আছে সমস্ত দুর্যোগ আর দুর্বিপাক মােকাবিলা
করার অদম্য প্রাণশক্তি। ফলে তারুণ্য ও যৌবনশক্তি দুর্বার বেগে এগিয়ে যায়
অগ্রযাত্রার পথে। যৌবনের উদ্দীপনা, সাহসিকতা, দুর্বার গতি, নতুন জীবন রচনার স্বপ্ন
এবং কল্যাব্রত—এসব বৈশিষ্ট্যের জন্য কবি প্রত্যাশা করেছেন নানা সমস্যাপীড়িত
আমাদের দেশে তারুণ্য ও যৌবনশক্তি যেন জাতীয় জীবনের চালিকাশক্তি হয়ে। দাড়ায় ।
নামকরণ ভূমিকা: পৃথিবীতে প্রতিটি জিনিসের একটা নাম আছে। তেমনি
সাহিত্য জগতেরও রয়েছে বিচিত্র নাম, বিচিত্র পরিচয়। কিন্তু যেমন-তেমন একটা নাম
নির্বাচন করেই লেখক তাঁর দায়িত্ব শেষ করতে পারেন না। কেননা সাহিত্যের নামকরণ হতে
হয় সার্থক, অর্থবহ এবং বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
নামকরণের রীতি ও নামকরণের যদিও কোন পূর্বশর্ত নেই, তবুও লেখক তাঁদের
সৃষ্টিকর্মের একটি সার্থক ও অর্থবহ নাম দেয়ার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে কবিতার
নামকরণের ক্ষেত্রে বিষয়বস্তু, অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এবং রূপক-সাংকেতিককে অবলম্বন
করা হয়ে থাকে। আমাদের আলোচ্য সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘আঠারো বছর বয়স' কবিতার
নামকরণ বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে করা হয়েছে। বিচার করে দেখতে হবে এই নামকরণ সঙ্গত
ও সার্থক কিনা ।
তাহারেই পড়ে মনে কবিতার ব্যাখ্যা লিঙ্ক
কবিতার গদ্যরূপ: আঠারো বছর বয়স হলে মানুষ মাথা তুলে দাঁড়াবার ঝুঁকি
নেয়। এ বয়সেই দুঃসাহসেরা উঁকি দেয়। আঠার বছর বয়সে কোন ভয় নেই। অতি কঠিন বাধা
এ বয়সে পদাঘাতে ভাঙতে চায়। এ বয়সে কেউ মাথা নোয়ায় না, এ বয়স কাদতে জানে না।
এ বয়স রক্তদান করে পুণ্য অর্জন করতে আগ্রহী। বাষ্পের বেগে স্টিমার
যেমন চলে, এ সময়ে তরুণরা ঠিক সেই রকম বেগে চলে। এ সময়ে প্রাণ দেওয়া আর। নেওয়ার
ঝুলিটা শূন্য থাকে না, শপথের কোলাহলে আত্মাকে সঁপে দেওয়া সম্ভব হয়।
আঠার বছর বয়স খুবই ভয়ঙ্কর। তরুণ তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা বিরাজ
করে বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর। এ বয়সে কানে নানা মন্ত্রণা আসে। আঠার বছর
দুর্বার বেগে পথে প্রান্তরে ঝড়ের মত চলে । কিন্তু দুর্যোগে হাল ঠিক রাখা কঠিন হয়
সমগ্র প্রাণ তাই ক্ষত-বিক্ষত হয় ।
আঠার বছর বয়সে আঘাত আসে অনবরত, অনেক আঘাত একত্রে জড়ো হয়ে জীবনকে কালো
করে তোলে, লক্ষ দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এ বয়স বেদনায় থরথর করে কাপে। তবু আঠারর
জয়ধ্বনি শুনেছি। দুর্যোগে আর ঝড়ে এ বয়স বেঁচে থাকে। বিপদের মুখে এ বয়স সামনে
এগিয়ে যায়। এ বয়স নতুন কিছু না কিছু করে ।
একথা জেনো যে, এ বয়স ভীরু কাপুরুষ নয়। পথ চলতে এ বয়স থেমে যায় না । তাই এ বয়সে কোন সংশয় নেই। এ দেশের বুকে আঠার নেমে আসুক।
কবি মানস: সুকান্ত ছিলেন
অনন্য প্রতিভার অধিকারী এক তরুণ কবি । নান্দনিক কবিতা রচনায় তিনি আগ্রহী ছিলেন
না। তার চেতনা ছিল প্রখর। পরাধীনতার। গানি তাকে পীড়িত করেছিল। জন্মেই তিনি
দেখেছিলেন ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি। দেশের সাধারণ মানুষ নির্যাতিত নিপীড়িত। অসাম্য,
অত্যাচার মানুষের মহিমাকে নত করে। দিয়েছে। ধনিকের নােয়ায় লোভে আকাশ ছুয়েছে। শোষকের
শোষণে সাধারণ মানুষ নিরক্ত হয়ে
এ অবস্থা তাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। তাই তিনি কবিতা লিখলেন মানুষের
আত্মবোধ জাগানোর জন্য, সাম্য শান্তি ও প্রগতির লক্ষ্যে। তিনি লিখলেন—
কবিতা আজকে তোমায় দিলাম ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
এই বাণীর মধ্যেই সুকান্তকে খুঁজে পাওয়া যায়। ক্ষুধা, দারিদ্র্য,
বঞ্চনা, অসাম্য যে সমাজে বিরাজ করছে সে সমাজে পূর্ণিমার চাঁদ নিয়ে কল্পনা-বিলাস
মানায় না। তাই তিনি কবিতার ভাষায় কঠিন কঠোর গদ্যের হাতুড়ি চালিয়েছেন অর্থাৎ
মানুষের মুক্তির গান রচনা করেছেন।
সুকান্ত ছিলেন সাম্যবাদে বিশ্বাসী। তিনি উলঙ্গ শিশুটার কথা বলেছেন,
রানারের জীবন সংগ্রামের বেদনাময় গান করেছেন। মানবতা ছিল তার অন্তরের মসৃণ
আকাঙ্ক্ষা, আর সাম্যবাদ ছিল তার চেতনার গভীরে প্রোথিত । অতি অল্প বয়সে মরণব্যাধি
তাকে হরণ করে নিয়ে গেছে। তাঁর প্রতিভার সূর্য ভোরের আলো বিকিরণ করেই রাহুগ্রাসে
অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। মধ্যাহ্ন গগনে উত্তরণ ঘটাতে পারেনি।
লালসালু উপন্যাসের বিষয়বস্তু জানতে
‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতায় কবি তারুণ্যের শক্তির স্বরূপ তুলে ধরেছেন। কবি এ কবিতার মাধ্যমে দেশময় তারুণ্যের জাগরণ কামনা করেছেন কারণ এই তারুণ্যই পারে জাতিকে সকল বন্ধন, অনাচার, অবিচার থেকে মুক্ত করে প্রাণপ্রাচুর্যে দ্বীপ্তিমান একটি দেশ উপহার দিতে। আঠারো বছর বয়স কোন বাধা মানে না, মাথা নত করে না। এই বয়স লোভ-লালসার উর্ধ্বে থেকে দেশের জন্য প্রাণ বিলিয়ে দিতে পারে। কবি আপন সত্তার জাগরণ ও উপলব্ধির ভেতর দিয়েই প্রত্যক্ষভাবে এ বয়সের উদ্দাম গতিশীলতার পরিচয় পেয়েছেন। তাই তিনি বলেছেন-‘এ বয়স জানে রক্ত স্নানের পূণ্য; তাই, এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়।’ এ বয়সে নানা মতবাদ তাদের বিভ্রান্ত করতে পারে, কিন্তু তাদের চলার গতিতে, তাদের কর্মে, তাদের চেতনায় কিছু করার প্রত্যয় প্রতিজ্ঞা। অলস, ভীরু, নিষ্ক্রিয় জাতির জীবনে একমাত্র তরুণরাই আনতে পারে সচলতা, সাহস এবং এই তরুণরাই পারে জাতির উত্তরণ ঘটাতে। তাই কবি এই কবিতায় এদেশে আঠারো বছর বয়সের যে ধর্ম সে ধর্মের আগমন আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করেছেন। এমর্মে কবির কামনা “এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে”