পল্লীজননী কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা। জসিম উদ্দীন

 



পল্লীজননী কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা।


রাত থম থম স্তব্ধ, ঘোর-ঘোর-আন্ধার,
নিশ্বাস ফেলি, তাও শোনা যায়, নাই কোথা সাড়া কার।

গভীর রাত, ঘন অন্ধকার। কোথাও একটু আলো নেই।কবি পল্লী গ্রামে রাতের বেলার নিস্তব্ধতাকে বোঝাতে উক্ত চরণের অবতারনা করেছেন। গ্রামের বেলায় রাতের প্রকৃতিতে এতটাই নীরবতা থাকে যে, নিঃশ্বাস ফেলার শব্দও শোনা যায় ।

রুগ্ন ছেলের শিয়রে বিসয়া একেলা জাগিছে মাতা,
করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা।

দুখিনী মা জেগে আছে এবং অসুস্থ ছেলের মাথার কাছে বসে আছে।ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্ত মা পরম যত্নে তার রুগ্ন ছেলের সেবা যত্ন করছেন। ঘুমে তার চোখ বুজে আসলেও সন্তানের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা তাকে জাগিয়ে রেখেছে।

শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে,
তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরাণ দোলে।

মায়ের পরম আদরের সন্তানের জীবন প্রদীপের সাথে কবি আগুন জ্বালানো প্রদীপের এক রূপক তুলনা করেছেন। শিয়র বলতে কবি রুগ্ন সন্তানের শয়নকালে মাথার দিকটিকে বুঝিয়েছেন। শিয়রের কাছের প্রদীপে আগুন নিভু নিভু হয়ে জ্বলছে। প্রদীপের জ্বালানী যখন শেষ হয়ে যায়, তখন আগুন নিভু নিভু হয়ে জ্বলে। ঠিক তেমনি পল্লী মায়ের আদরের সন্তানের জীবন প্রদীপের আয়ু শেষের দিকে। তা দেখে দুঃখিনী মায়ের প্রাণ বিরহকাতর।

ভন্ ভন্ ভন্ জমাট বেঁধেছে বুনো মশকের গান,
এঁদো ডোবা হতে বহিছে কঠোর পচান পাতার ঘ্রাণ।

বনের ঝোপঝাড় থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা আসছে। তাদের ভনভন শব্দ শোনা যাচ্ছে।ডোবার পানিতে পচে যাওয়া পাতা হতে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। মা তার রুগ্ন সন্তানকে নিয়ে যেই পরিবেশে রাত জাগছেন, তা মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়।

ছোট কুঁড়ে ঘর, বেড়ার ফাঁকেতে আসিছে শীতের বায়ু,
শিয়রে বসিয়া মনে মনে মাতা গণিছে ছেলের আয়ু।

রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসে আছেন দুঃখিনী মা। ছেলের শারীরিক অবস্থা তার মনে ভয়ের সঞ্চার করছে। প্রিয় সন্তানের শরীরের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। অসহায় মা সন্তানের মাথের কাছে বসে সন্তানের পরমায়ুর কথা ভেবে শঙ্কিত হচ্ছেন।

বঙ্গবাণী কবিতার বিশ্লেষণ পড়তে ক্লিক করো

ছেলে কয়, “মারে, কত রাত আছে? কখন সকাল হবে,
ভাল যে লাগে না, এমনি করিয়া কেবা শুয়ে থাকে কবে।”
মা কয়“বাছারে ! চুপটি করিয়া ঘুমা ত একটি বার, ”
ছেলে রেগে কয় “ঘুম যে আসে না কি করিব আমি তার

অসুস্থ ছেলে মাকে ডেকে জানতে চায়- রাত আর কতটুকু বাকি, কখন সকাল হবে, তার আর শুয়ে থাকতে ভালো লাগে না। ছেলেকে আদর করে মা তাকে ঘুমাতে বলে, কিন্তু ছেলে ঘুমায় না। ঘুম না এলে সে কীভাবে ঘুমাবে ?

পান্ডুর গালে চুমো খায় মাতা, সারা গায়ে দেয় হাত,
পারে যদি বুকে যত স্নেহ আছে ঢেলে দেয় তারি সাথ।

মা, অসুস্থ ছেলের গালে চুমু খায়। সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়।ছেলের কষ্ট দেখে দুঃখিনী মা কিছুই করতে পারে না। ছেলের স্বস্তির জন্য তাই অসহায় মা তার সমস্ত আদর স্নেহ ঢেলে দিতে চায়।

নামাজের ঘরে মোমবাতি মানে, দরগায় মানে দান,
ছেলেরে তাহার ভাল কোরে দাও, কাঁদে জননীর প্রাণ।

অসহায় মা খোদার কাছে প্রার্থনা করছেন যে, তার পরম আদরের সন্তান যেন সুস্থ হয়ে যায়।

ভাল করে দাও আল্লা রসুল ভাল করে দাও পীর।
কহিতে কহিতে মুখখানি ভাসে বহিয়া নয়ন নীর!

আল্লাহ, রসূল, পীর কে ডেকে তার সন্তানকে সুস্থ করে দিতে বলে। ছেলের রোগমুক্তির প্রার্থনা করে মায়ের চোখ জলে ভেসে যায়।

বাঁশবনে বসি ডাকে কানা কুয়ো, রাতের আঁধার ঠেলি,
বাদুড় পাখার বাতাসেতে পড়ে সুপারীর বন হেলি।

গভীর রাতের ঘন অন্ধকার ভেদ করে বাঁশবাগান থেকে কানা কুয়োর ডাক ভেসে আসে, সুপারির বনে বাদুর পাখা ঝাপটায়।

চলে বুনোপথে জোনাকি মেয়েরা কুয়াশা কাফন ধরি,
দুঃ ছাই ! কিবা শঙ্কায় মার পরাণ উঠিছে ভরি।

সন্তানের এই চরম অসুস্থতার মুখে অসহায় মায়ের মনে নানা অশনি সংকেত উঁকি দেয়। তার কল্পনা গ্রামের অন্ধকারাচ্ছন্ন ঝোপ-জঙ্গল আচ্ছাদিত করে তুলে। শীতল কুয়াশায় জোনাকিরা উড়ে যাচ্ছে। কুয়াশার অবয়ব দেখে মনে হচ্ছে কাফনের কাপড়। জোনাকিরা মায়ের পরম আদরের সন্তানকে নিয়ে কুয়াশার কাফন ভেদ করে চলে যাচ্ছে।

কপোতাক্ষ নদ কবিতার ব্যাখ্যা জানতে ক্লিক করো

ছেলে কয়, “মাগো! পায়ে পড়ি বল ভালো যদি হই কাল,
করিমের সাথে খেলিবারে গেলে দিবে না ত তুমি গাল।

ছেলে মাকে খুব অনুনয় করে বলছে কাল যদি সে ভালো হয়ে যায় তাহলে করিমের সঙ্গে খেলতে গেলে মা যেন তাকে আর বারণ না করে।

আচ্ছা মা বলো, এমন হয় না রহিম চাচার ঝাড়া,
এখনি আমারে এত রোগ হোতে করিতে পারি ত খাড়া?”

গ্রামের মানুষের মনে ঝাড়-ফুঁক , পানি পড়া এসবের প্রতি বিশ্বাস রয়েছে। তাই রুগ্ন সন্তানের মনে আশা জাগে- রহিম নামের জনৈক লোকের ঝাড় ফুঁকে হয়তোবা তার সকল রোগ বালাই নিমিষেই ভালো হয়ে যেতে পারে।

মা কেবল বসি রুগ্ন ছেলের মুখ পানে আঁখি মেলে,
ভাসা ভাসা তার যত কথা যেন সারা প্রাণ দিয়ে গেলে।

অসহায় মা তার সন্তানের জন্য কিছুই করতে পারেন না। তিনি সন্তানের চোখের দিকে করুণভাবে তাকিয়ে থাকেন। সন্তানের অসুস্থতা জড়ানো মুখের আধো আধো বুলি পরম ভালবাসা ভরে শুনতে থাকেন।

শোন মা! আমার লাটাই কিন্তু রাখিও যতন করে,
রাখিও ঢ্যাঁপের মোয়া বেঁধে তুমি সাত-নরি সিকা ভরে।
খেজুরে-গুড়ের নয়া পাটালিতে হুড়ুমের কোলা ভরে।
ফুলঝুরি সিকা সাজাইয়া রেখো আমার সমুখ পরে।”
ছেলে চুপ করে, মাও ধীরে ধীরে মাথায় বুলায় হাত,
বাহিরেতে নাচে জোনাকী আলোয় থম থম কাল রাত।

ছেলে মাকে তার লাটাই যত্ন করে রেখে দিতে বলে অর্থাৎ যা দিয়ে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। সাত-নরি সিকা ভরে ঢ্যাপের মোয়া বেঁধে রাখতে বলে। হুড়ূমের কোলা ভরে খেজুরের পাটালি গুড় রাখতে বলে। তার সামনে ফুলঝুরি শিকায় সেগুলো সাজিয়ে রাখতে বলে। বলতে বলতে চুপ হয়ে যায় ছেলে। মা ছেলের মাথায় হাত বুলাতে থাকে। কুঁড়ে ঘরের বাইরে জোনাকির আলোতে স্তব্ধ রাত চলতে থাকে।

মানুষ কবিতার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ এখানে

রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া কত কথা পড়ে মনে,
কোন দিন সে যে মায়েরে না বলে গিয়াছিল দুর বনে।
সাঁঝ হয়ে গেল আসেনাকো আই-ঢাই মার প্রাণ,
হঠাৎ শুনিল আসিতেছে ছেলে হর্ষে করিয়া গান।
এক কোঁচ ভরা বেথুল তাহার ঝামুর ঝুমুর বাজে,
ওরে মুখপোড়া কোথা গিয়াছিলি এমনি এ কালি সাঁঝে।

দরিদ্র অসহায় মা তার সন্তানের অনেক বায়নাই পূরণ করতে পারেননি। সেই কথা দুঃখভারাক্রান্ত মনে স্মরণ করছেন তিনি। মেলার দিনে তার সন্তান পুতুল কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু পুতুল কিনে দেবার মত পয়সা তার কাছে ছিল না। দরিদ্র মা তার সন্তানকে এই বলে অজুহাত দেখান যে মুসলমানদের মেলায় যাওয়া বারণ। সন্তানের জীবনের শেষ মুহূর্তে এই সকল দুঃখ ভরা স্মৃতি মায়ের মনকে আরও বেশি হতাশায় ভরিয়ে দেয়।

কত কথা আজ মনে পড়ে মার, গরীবের ঘর তার,
ছোট খাট কত বায়না ছেলের পারে নাই মিটাবার।
আড়ঙের দিনে পুতুল কিনিতে পয়সা জোটেনি তাই,
বলেছে আমরা মুসলমানের আড়ঙ দেখিতে নাই।

করিম যে গেল? আজিজ চলিল? এমনি প্রশ্ন-মালা;
উত্তর দিতে দুখিনী মায়ের দ্বিগুণ বাড়িত জ্বালা।

মায়ের কথায় ছেলে যুক্তি দেখায়, করিম গিয়েছে, আজিজ যাচ্ছে তাহলে সে যেতে পারবে না কেন? ছেলের প্রশ্নের উত্তর দিতে মায়ের মনে অভাবের যন্ত্রনার জ্বালা আরও বেড়ে যেত।

আজও রোগে তার পথ্য জোটেনি, ওষুধ হয়নি আনা,
ঝড়ে কাঁপে যেন নীড়ের পাখিটি, জড়ায়ে মায়ের ডানা।

অসহায় মা তার সন্তানের জন্য কোনও ওষুধ যোগাড় করতে পারেননি। ঝড়ের সময় পাখির ছানা তার মায়ের ডানাকে ভয়ে জাপটে ধরে।

ঘরের চালেতে হুতুম ডাকিছে, অকল্যাণ এ সুর,

গ্রাম বাংলার মানুষ নানা ধরণের কুসংস্কারে বিশ্বাস করে। হুতুম পাখির ডাককে মৃত্যুর ইঙ্গিতবহ বলে মনে করা হয়। এই জন্যই হুতুম পাখির ডাককে অকল্যাণকর বলা হয়েছে এবং হুতুম পাখির ডাক শুনে মা সন্তান হারানোর ভয়ে শিউরে ওঠেন।

রানার কবিতার বিশ্লেষণ এই লিঙ্কে

মরণের দুত এল বুঝি হায়। হাঁকে মায়, দূর-দূর ।
পচা ডোবা হতে বিরহিনী ডা’ক ডাকিতেছে ঝুরি’ ঝুরি’,
কৃষাণ ছেলেরা কালকে তাহার বাচ্চা করেছে চুরি।
ফেরে ভন্ ভন্ মশা দলে দলে,বুড়ো পাতা ঝরে বনে,
ফোঁটায় ফোঁটায় পাতা-চোঁয়া জল ঝরিছে তাহার সনে।

পচা ডোবা থেকে ডাহুক ডাকছে। কৃষাণ ছেলেরা গতকাল তার বাচ্চা চুরি করেছে। আবার সেই বুনো মশা ভনভন করছে , গাছ থেকে বুড়ো পাতা ঝরে পড়ছে। সেই সঙ্গে পাতা- চুঁয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে কুয়াশায় জমা জল

রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা।
সম্মুখে তার ঘোর কুজঝটি মহাকাল রাত পাতা।

রুগ্ন সন্তানের রোগমুক্তির আশায় অসহায় মা তার সন্তানের কাছে বসে রাত জাগছেন। কিন্তু মায়ের মন সন্তান হারানোর শঙ্কায় আচ্ছন্ন। অসহায় মায়ের সামনে এখনো শীতের বিশাল রাত পড়ে আছে। সেই বিশাল রাত তার কাছে ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হয়।

পার্শ্বে জ্বলিয়া মাটির প্রদীপ বাতাসে জমায় খেল;
আঁধারের সাথে যুঝিয়া তাহার ফুরায়ে এসেছে তেল।

রুগ্ন সন্তানের পরমায়ুকে অসহায় মা প্রদীপের তেল ফুরিয়ে আসার সাথে তুলনা করছেন। বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা প্রদীপ আর রোগের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা রুগ্ন সন্তান যেন একটি আরেকটির প্রতিমূর্তি। কবি এই চরণগুলোতে মায়ের রুগ্ন সন্তানের মৃত্যুর আগমনকে রূপক অর্থে তুলে ধরেছেন।

 স্বাধীনতা এই শব্দটি কীভাবে.. ব্যাখ্যা

 

 

 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন