শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে সমাজ বাস্তবতা আলোচনা কর।

 


প্রশ্ন: শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে সমাজ বাস্তবতা আলোচনা কর।

মধ্যযুগের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের সমাজচিত্র। 


    সাধারণভাবে সাহিত্যকে সমাজ জীবনের র্দপণ বলা হয়। কারণ কোন সাহিত্যিকের পক্ষে সমসাময়িক রুচি বা জীবনকে অস্বীকার করা একবোরইে অসম্ভব। আর তাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহিত্যে বিষয়বস্তু উপকরণ, উপাদান হিসাবে সমকালীন সমাজ জীবন সাহিত্যে প্রোথিত হয়। মধ্যযুগের অন্যতম শ্রষ্ঠে কবি চণ্ডীদাস রচতি “শ্রীকৃষ্ণর্কীতন” কাব্যেও এর ব্যতিক্রম ঘটে নি। দেবলোক থেকে মর্তে নেমে আসা রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমের কাহিনি র্বণনা করতে গিয়ে কবি সমকালীন সমাজের বিভিন্ন চরিত্রের র্বণনা করছেনে।

          কাব্যটি রচনার সময় বঙ্গদশেরে সমাজ ব্যবস্থা ছিল নৈতিক অবক্ষয়রে করাল গ্রাসে নিপাতিত। এই কাব্যরে নায়ক কৃষ্ণগোপী পল্লীর অর্মাজতি যুবক, দুঃসাহসী, লম্পট গরু রাখাল ও নায়িকা রাধা নপুংশক স্বামীর বাল্য বিবাহিতা স্ত্রী। দান খণ্ড থেকে শুরু করে বিরহ খণ্ড পর্যন্ত সর্বত্রই অশ্লীলতায় ভরপুর। দেহমিলন আর ভোগই ছিল সে সমাজের নারী পুরুষ প্রেমের  মূখ্য বিষয়।

    বাল্য বিবাহ সে সময়ের সামাজিক রীতি ছিল তা রাধার বাল্য বিবাহ দ্বারাই প্রমাণিত। অল্প বয়সে রাধা নপুংশক স্বামী আইহনের বধূরুপে প্রবশে করে। স্বামী র্সম্পকে অনভিজ্ঞ রাধার প্রমাণ মেলে কৃষ্ণের প্রতি রাধার উক্তিতে

“এহে সকল বএসে মোর এগার বরিষে

বারহ বরিয়ে দান মোর চাহ মোর কিসে [ দানখণ্ড]

    তখনকার দিনে বিবাহ বা প্রেমের প্রস্তাবের সঙ্গে ভাবী স্ত্রী বা প্রেমিকাকে ফুল বা পান পাঠানোর একটি রীতি প্রচলতি ছিল। আর তাই বড়ায়ির মুখে রাধার রুপের র্বণনা শুনে কৃষ্ণ তখন অদম্য আর্কষণ অনুভব করল এবং কৃষ্ণ রাধাকে উপহার স্বরুপ ফুলতাম্বুলাদি পাঠিয়েছিল।

          বৃন্দাবন খণ্ডের দু-একটি পদে গ্রাম বাংলার সমাজ জীবনের একটি সুন্দর ছবি লক্ষ্য করা যায়। সে সময়ে বধূদেরকে ঘর থেকে বাহিরে যাবার স্বাধীনতা দেয়া হত না। কোন উপলক্ষ্য থাকলে সখীদের সঙ্গে আনন্দ করার ব্যাপারে কোন আপত্তি নইে। কিন্তু রাধাকে বৃন্দাবনে যেতেই  হবে কারণ সেখানে কৃষ্ণ অপেক্ষা করছে তাই রাধার পরার্মশ অনুযায়ী বড়াই প্রত্যকে সখীর শাশুড়ীর কাছ থেকে মথুরার হাটে দধি-দুধ বেচার প্রস্তাব করে । র্অথ্যাৎ সে সময়ে গোপ জাতিদের কে দধি-দুধ বিক্রি কর জীবিকা নির্বাহ করতে হত।

সে সময়কার গ্রাম্য সমাজে নারী পুরুষ একে অন্যকে অশ্লীল ভাষায় গালগিালাজ করত। নারীদরে কারণে অকারণে শপথ করা ছিল স্বভাব র্ধম। কৃষ্ণকে বড়াই বলেছিল যদি সে তার কথা না শুনে তবে ব্রহ্ম হত্যার পাতক হব।

ধর্মবোধ সবকালইে র্ধমভীরু মানুষের নৈতিকতা নিবারণে সাহায্য করে। ধর্মবোধের কারণেই রাধা কৃষ্ণের প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছিল। আর এর সাথে যুক্ত হয়েছিল স্বতীত্ববোধের গভীর প্রেরণা। মূলত র্ধমবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ইে কৃষ্ণের পাঠানো উপহার পদদলতি করছিল।

          শ্রীকৃষ্ণর্কীতন কাব্যে তৎকালীন সমাজের তান্ত্রিক সাধনার ছায়াপাত লক্ষ্য করা যায় বিরহ খণ্ডে বিরহ খণ্ডে কৃষ্ণের সাথে রাধার সাক্ষাৎ ঘটলে রাধা দৈহিকভাবে কৃষ্ণকে কামনা করে কিন্তু— কৃষ্ণ তার জবাবে বলে যে সে কামনা বাসনার র্উধ্বে অবস্থান করে।


          কাব্যের মধ্যে বহু জায়গায় কৃষ্ণের আচরণের মাধ্যমে তৎকালীন সমাজের পুরুষদের নির্লজ্জ ভণ্ডামীর বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। কৃষ্ণ ছলে বলে কৌশলে তার কাঙ্ক্ষিত রমণী রাধাকে পাবার জন্য সে যে কোন পথ গ্রহণ করেছে আবার রাধা যখন কৃষ্ণকে পাবার জন্য ঘর সংসার ত্যাগ করেছে তখন কৃষ্ণ তাকে গুটিয়ে নিয়েছে।  

          রাধার অংলকারে সে যুগের নারীদের ব্যবহৃত অলংকার পরচিয় মেলে সিঁথির সিঁদূর, পায়ে নূপুর, গলায় গজমুক্তার হার প্রভৃতি।  আর কৃষ্ণের পোষাক র্বণনায় পুরুষের অলংকারের পরিচয় পাওয়া যায়।

          তখনকার সমাজে চণ্ডীদেবীর পূজা বিশেষভাবে করা হত। রাধাকে বড়াই বলেছে - যত্ন সহকারে চণ্ডীকে পূজা করে সন্তুষ্টি করতে পারলইে কৃষ্ণের সন্ধান মিলবে।

          বংশীখণ্ডের দু-একটি পদে তখনকান সমাজরে খাদ্যবস্তু ও ব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। বাঁশির সুরে রাধার রান্নায় অমনোযোগী হয়ে যায়। যেমন-

“অম্বল ব্যঞ্জন শআের, দিলো

শানে দিলো কানা শোঁআ পাণী”

          আচার, অনুষ্ঠান, সংষ্কার প্রভৃতির বেড়াজালে বাঙালী সমাজ চিরদিনই পীড়িত। বিশেষ করে কুসংষ্কার বাঙালির মজ্জাগত। তাই আমরা রাধাকে বলতে শুনেছি...

কোণ অসুভ খণে পাঅ বাঢ়ায়িলো।

হাঁছী জঠি আয়র ঊঝঁট না মানিলো।

          পরিশেষে আমরা বলতে পারি রাধা কৃষ্ণ লীলা বিষয়ক কাব্য হওয়া সত্ত্বেও কবি চণ্ডীদাস “শ্রীকৃষ্ণর্কীতন” কাব্যের মাধ্যমে তৎকালীন বাংলা সমাজের যে র্বণনা পাই তা পরমিাণে খুব বেশি না হলেও তার মূল্য কম নয়।

 

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন