কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে নবকুমার চরিত্র।। নবকুমার চরিত্র

 



কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে নবকুমার চরিত্র

বাংলা সাহিত্যের এক পরম শুভলগ্নে উপন্যাস সাহিত্যের আর্বিভাব। মধ্যযুগীয় এক ঘেয়েমি গীতিগাথা ও পদাবলীর পালা তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সমাজ ক্রোড়ে জন্ম নিয়েছে আধুনিকতা। বাংলা উপন্যাস সাহিত্য একান্ত ভাবেই আধুনিকতার সন্তান। আর এ আধূনিক উপন্যাসের সার্থক সষ্ট্রা হচ্ছেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি উপন্যাসের সষ্ট্রা ও সার্থক উপন্যাস সৃষ্টির ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বে দাবিদার। কপালকুণ্ডলা উপন্যাসটি তার এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দ্বিতীয় সার্থক উপন্যাস। কপালকুণ্ডলার রোমান্টিক আবেষ্টন রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র অদ্ভুত প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ইতিহাস ও প্রেমকে যতদুর সম্ভব পেছনে ফেলে রেখে রোমান্সের এমন এক উৎস আবিষ্কার করেছেন যা আমাদের  বাস্তব জীবনের কঠিন মৃত্তিকা হতে সত্বঃই উৎসারিত হতে পারে।

কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের নায়ক চরিত্র নবকুমার। তাকে নিয়েই উপন্যাসের শুরু এবং সর্বপ্রথম তাকে নায়কোচিত গুণে মণ্ডিত করে ঔপন্যাসিক আমাদের কাছে উপস্থাপন করেছেন। আবার তার জীবন বিসর্জনের সাথে সাথে কাহিনী শেষ হয়েছে।

আধুনিক সময়ে ব্যক্তিত্বের মহত্ত্বকে নায়ক চরিত্রের অন্যতম গুণ বলে গণ্য করা হয়। চরিত্রের দোষ গুণের মাত্রা পরিমাপের বিচারে শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গিই মূল কথা। নায়কের উদ্যম বা ক্রিয়াশীলতা বলতে দৈহিক, মানসিক বা আত্মিক ক্রিয়ার কথাই বুঝে থাকি। এসব বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে ‘কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের নায়ক চরিত্রের বিচার করা সম্ভব। 

কপালকুণ্ডলা চরিত্র বিস্তারিত এখানে

নবকুমার ব্রাহ্মণ সন্তান, মৃদুভাষী, উদারচিত্ত, পরোপকারী, সংযত ও পরিশীলিত এক ব্যক্তিত্ব। তার রূপমুগ্ধতা প্রকৃতি ও নারী উভয়কে ঘিরে আবর্তিত। নবকুমার গভীর জীবনবোধের সত্য সন্ধানে আগ্রহী। তারই রূপরেখায় তার চরিত্র নির্মিত। সে দোষে-গুণে, রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। সাহস এবং হৃদয়ের ঔদার্য আত্মত্যাগ ব্রতে তাকে দীক্ষা দিয়েছে; অপরের আহার নিবৃত্ত করার জন্য কাষ্টাহরণে যেয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করতে দ্বিধাবোধ করে না।

নবকুমার চরিত্রের প্রথম আর্থিভাবেই ঔপন্যাসিক তার মধ্যে নিসর্গপ্রীতি ও সৌন্দর্যের ভাবকে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। নবকুমারের সৌন্দর্যপ্রীতি, রূপমুগ্ধতা তার চরিত্রস্বভাব। নীল সমুদ্রের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য তাকে বারংবার মোহিত করে।

নবকুমারের চরিত্রে আমরা রক্ষ্য করি যে তার ভাবুকতা আছে, রহস্যপ্রিয়তা আছে, কিন্তু কঠিন বিপদের সময় কোন অস্থিরতার চিহ্ন দেখা যায় না। বিপদ যখন চারিদিকে ঘনায়মান, সাগরতরঙ্গে প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তখনও ভীতবিহ্বল নন, স্থিরচিত্তে আতঙ্কিত মাঝিকে তিনি নৌকা চালনার নির্দেশ দান করেন। এখানে নবকুমারের পরিশীলিত, মার্জিত, রুচি ও সংযতভার তার ব্যক্তিত্বকে উজ্জল রেখায় চিত্রিত করেছে।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে সমাজ এখানে

নবকুমারের চরিত্রের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বিশ্বাস প্রবণতা। এ প্রবণতা ছিল বলেই তিনি তার সাথীদের বিশ্বাস করে ছিলেন। উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে আমরা দেখতে পাই সাথীদের আহার নিবৃত্ত করার জন্য কাষ্টাহরণে যান কিন্তু তার বিলম্ব দেখে সাথীরা তাকে ফেলে রেখে যায়। আবার উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের চতুর্থ পরিচ্ছেদে কাপালিকের সাথে তার পরিচয় হয় বিশ্বাস প্রবণ নবকুমার কাপালিক কে বিশ্বাস করলেও আমরা এই উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে দেখতে পাই সেই কাপালিক তাকে হত্যার জন্য বধ্যভূমিতে নিয়ে চলেছেন। আবার এই উপন্যাসের চতুর্থ খণ্ডের প্রথম পরিচ্ছেদে আমরা দেখতে পাই কপালকুণ্ডলার সাথে রাতে অরণ্যে যেতে চাইলে কপালকুণ্ডলা বলেছিল আমি অবিশ্বাসিনী কিনা দেখে যাও। তাই নবকুমার তার সাথে যায় নি।

নবকুমার আবেগপ্রবণ যুবক। কিন্তু মতিবিবির সাথে আচরণে তার আবেগের লক্ষণ দেখা যায় না। পরদুঃখ কাতর যুবক নবকুমার সমাজের শৃঙ্খল অতিক্রম করতে পারে নি। মুসলমান নারী বলে সে পদ্মাবতীকে ত্যাগ করেছে। তাকে গ্রহণ করা সেকালে সম্ভব ছিল না।

মতিবিবির সাথে আচরণে নবকুমার যথেষ্ট বিবেচক। বিপন্না মতিবিবিকে চটিতে পৌঁছুতে সাহায্য করেছে। তাকে বলেছে “ বিপদকালে সংকোচ মূঢ়ের কাজ আমার কাধে ভর করিয়া চল। মতিবিবি তার কাছে দাসীত্ব ভিক্ষা করলে নবকুমার বিবেচক ব্যক্তির মতই তাকে সদুপদেশ দিয়েছে এবং কঠোর ভাবে মতিবিবির প্রর্থনা প্রত্যাখান করতে দ্বিধা করে নি।

সমালোচক ও অধ্যাপক অরুণকুমার বসু ‘কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের নবকুমার চরিত্র পর্যালোচনায় লিখেছেন - মনোভাব ও সুক্ষবিদবৃত্তিতে আধুনিক হয়েও নবকুমার তিনটি কাল চেতনার অভিজ্ঞতার দ্বারা স্পষ্ট। একটি প্রাগৈতিহাসিক বিশ্বাসের কাল, একটি সময়রেখাহীন অসীম কাল এবং আর একটি নির্দিষ্ট দেশনামযুক্ত ইতিহাসের কাল। কাপালিক, কপালকুণ্ডলা ও মতিবিবি এই তিনটি কালের প্রতীক। নবকুমারকে ঘিরে এই তিনটি কাল একই সময়ে আর্বিভূত হয়েছে।

আবার আধুনিক মনমানসিকতায় যুক্তিবাদী সে। আধুনিক যুক্তিবাদী মননে, সৌন্দর্যপ্রীতি ও পকৃতি প্রেমে ১ম দুটি পরিচ্ছেদেই নবকুমারের নায়কোচিত গুণের পরিচয় পাওয়া যায়। তার শিক্ষা, বুদ্ধি, সামাজিক জ্ঞান ছিল অতন্ত্য প্রখর।

জীবননান্দ দাশের প্রকৃতি চেতনা এই লিঙ্কে

নবকুমার উদার স্বভাব পরোপকারী যুবক। পরোপকার করার সুযোগ পেলে তিনি আত্মচিন্তা করেন না। সম্যক বিবেচনা না করেই তিনি কাষ্ঠাহরণে গিয়েছেন। সেই কারণেই তাকে নির্বাসিত হতে হয়েছে। অধিকারী তাকে কপালকুণ্ডলার প্রাণ রক্ষা করতে বললে নবকুমার বললেন- “ আমি এমন সংকল্প করিতেছে যে, আমি সেই নরঘাতকের নিকট প্রত্যাগমন করিয়া আত্মসর্ম্পণ করি। তাহা হইলে ইহার প্রাণ রক্ষা হইবে। পরে কপালকুণ্ডলাকে বিয়ে করে তার প্রাণ রক্ষা করে।

নবকুমারের চরিত্রে কোন ঈর্ষাবোধ নেই। কারণ সে নিয়তির সন্তান। আর তাই তার চরিত্রে কোন সংগ্রামের ভাব দেখা যায় না। সে নিয়তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

বঙ্কিমচন্দ্র নবকুমারকে রক্তমাংসের আদলে সৃষ্টি করেছেন। উপন্যাসের বাস্তব ভিত্তি ও চরিত্র সংযোজনে দৃঢ় হয়েছে সন্দেহ নেই। সাগরতীরবাসিনী কাপালিত প্রতিপালিতা কপালকুণ্ডলা কালস্রোতে ভেসে গেলেন, নবকুমারও তার পথ অনুসরণ করলেন। এভাবেই তার করুণ পরিণিতির মধ্যে দিয়ে উপন্যাসের পরিসমাপ্তি ঘটে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন