কপালকুণ্ডলার চরিত্র
বাংলা সাহিত্যের এক পরম শুভলগ্নে উপন্যাস সাহিত্যের আর্বিভাব। মধ্যযুগীয় এক ঘেয়েমি গীতিগাথা ও পদাবলীর পালা তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সমাজ ক্রোড়ে জন্ম নিয়েছে আধুনিকতা। বাংলা উপন্যাস সাহিত্য একান্ত ভাবেই আধুনিকতার সন্তান। আর এ আধুনিক উপন্যাসের সার্থক সষ্ট্রা হচ্ছেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি উপন্যাসের সষ্ট্রা ও সার্থক উপন্যাস সৃষ্টির ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বে দাবিদার। কপালকুণ্ডলা উপন্যাসটি তার এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দ্বিতীয় সার্থক উপন্যাস। কপালকুণ্ডলার রোমান্টিক আবেষ্টন রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র অদ্ভুত প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ইতিহাস ও প্রেমকে যতদুর সম্ভব পেছনে ফেলে রেখে রোমান্সের এমন এক উৎস আবিষ্কার করেছেন যা আমাদের বাস্তব জীবনের কঠিন মৃত্তিকা হতে সত্বঃই উৎসারিত হতে পারে।
বঙ্কিমের অসামান্য সৃষ্টি কপালকুণ্ডলা চরিত্র। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কোন চরিত্রের সাথে এর তুলনা করা যায় না। সমুদ্রতীরবাসিনী প্রকৃতি কন্যা কপালকুণ্ডলা অরণ্য লতার মত দিন দিন বেড়ে উঠেছে। ছোটোবেলা থেকে যে দু’জন মানুষ তার জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছে তাদের একজন হল কাপালিক ও অন্যজন অধিকারী। প্রকৃতির সাথে তার আত্মিক যোগ রয়েছে। প্রকৃতির রহস্যময়তায় কপালকুণ্ডলা জীবনদোলায়িত ছন্দে পরিণামমুখী। আর্বিভাবের মূহূর্ত থেকে এই ছন্দের আভাস। তার অদৃশ্য, অবগুন্ঠনাবৃত্ত উপস্থিতি প্রকাশ্য দিবালোকে নয়- রাত্রির অন্ধকারে তার সচ্ছ পদচারণা। প্রকৃতির মত তা নিরাভরণ দেহ। প্রকৃতির নির্মল রুপের মাঝে সে এমন ভাবে মিশে গিয়েছে যে নবকুমার তাকে প্রথম দেখে এক অনৈসর্গিক শক্তির অপরুপ সৌন্দর্যময়ী নারীমূর্তি বলে মনে করেছিল। মায়াবী মূর্তির অপরুপ রুপ ব্যঞ্জনায়, অদৃশ্য জগতের আভাস পাওয়া যায় তার লীলাচপল পদ বিক্ষেপে উপস্থিতি প্রমাণিত হয় শব্দধ্বনির সুর-মূর্চ্ছনায় “ পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ?” আবিষ্ঠ করে নবকুমারের চৈতন্যকে।
রুপসী বাংলা কাব্যে জীবননান্দ দাশের মৃত্যুচেতনা এই লিঙ্কে
সামাজিক জীবনে প্রবেশের পরেও বাল্যকালের রোমান্টিক প্রতিবেশ কপালকুণ্ডলাকে আবেষ্টন করতে ছাড়ে নি। পারিবারিক জীবনের নিয়ম শৃঙ্খল,স্বামীর অপরিমিত ভালবাসাও তার নয়নের অপার্থিব স্বপ্নঘোর ঘুচাতে পারে নি। তার অন্তরের মধ্যে যে একটি চির উদাসিনী আলুলায়িতকুন্তলা অতীত স্বাধীনতার দিকে চেয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলছিল, তাকে সংসারের শত আদর প্রলোভন পোষ মানাতে পারে নি। অথচ তার মধ্যে একটা অসামাজিক বন্যতা বা রমনী সুলভ কোমলতার অভাস ছিল না। রবীন্দ্রনাথের “অথিতি” গল্পের নায়ক “তারাপদ’ই” কপালকুণ্ডলার একমাত্র তুলনাস্থল; অথচ আবেষ্টনের অসাধারণত্বে ও প্রকৃতি বৈশিষ্ঠ্যে এদের মধ্যে অনেক প্রভেদ।
কপালকুণ্ডলার সংসার জীবনের প্রতি ছিল অনাসক্তি, প্রকৃতির নিত্য আকর্ষণ ও ভবানীর অনিচ্ছার ইঙ্গিত তার জীবনকে ঔদাসীন্যে পূর্ণ করেছে। আমরা প্রথম খণ্ডের পঞ্চম পরিচ্ছেদে দেখতে পাই কপালকুণ্ডলার সাথে নবকুমারের পরিচয় হয়, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে কপালকুণ্ডলা নবকুমারকে কাপালিকের হাত থেকে রক্ষা করে এবং সপ্তম পরিচ্ছেদে নবকুমারের সাথে অধিকারী তার বিবাহ দেন। কিন্তু বিবাহের পর কপালকুণ্ডলার তার সংসারের মাঝে আনন্দ খুজে পাই নি। যেমন সে শ্যামাসুন্দরীর প্রশ্নের উত্তরে বলেছিল যে, “প্রস্ফুটিত পুষ্পের সৌন্দর্য মানুষকে আনন্দ দিতে পারে, কিন্তু তাতে পুষ্পের সার্থকতা কোথায়?”
কপালকুণ্ডলার চরিত্রের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল পরোপকার করার মনোবাসনা। তার এই ধরণের প্রবৃত্তির পেছনে রয়েছে অন্তরের গভীর মমতা। সেই মমত্ত্ববোধ থেকেই সে নবকুমারকে কাপালিকের হাত থেকে রক্ষা করে, শ্যামাসুন্দরীর উপকারের কথা ভেবেই রাতের অন্ধকারের ঔষধ সংরক্ষণের জন্য বনে প্রবেশ করে যেখানে তার সাথে পদ্মাবতীর সাথে দেখা হয়। পরর্বতীতে সে জানতে পারে পদ্মবতী তার সপত্নী। সকল কিছু জানার পর সে সপত্নীর সুখের পথ রুদ্ধ করতে চায় নি। পদ্মাবতীকে সে বলে ‘আমি তোমার সুখের পথ কেন রোধ করিব? “আমি বনচর ছিলাম আবার বনচর হইব”।
রুপসী বাংলা কাব্যে জীবননান্দ দাশের প্রকৃতিচেতনা এখানে
বঙ্কিমচন্দ্র এই উপন্যাসে যে সকল অলৌকিক দৃশ্যের অবতারণা ঘটিয়েছেন তা কবি কল্পনার ন্যায় সৌন্দর্যমাত্রাত্মক নয়; বরং কপালকুণ্ডলার চরিত্রের সাথে একটি নিগূঢ় ও সুসংগতসমন্ধবিশিষ্ট। নবকুমারের সাথে আগমন কালে ভবিষ্যত শুভাশুভ জানার জন্য দেবী পদে বিল্বপত্রাপর্ণ কেবল একটা পূজার বাহ্য অনুষ্ঠান মাত্র নয়, এটি ছিল কপালকুণ্ডলার ভক্তি প্রবণ হৃদয়ে একটি অজ্ঞাত আশংকার ছায়া ফেলে তার নূতন জীবনের প্রতি অনাসক্তি বাড়িয়ে তুলেছে ও ভবিষ্যতের বিপৎপাতের ক্ষেত্র প্রস্তুতকরণে সাহায্য করেছে।
কাপালিক দ্বারা প্রভাবিত হলেও কপালকুণ্ডলা তার ধর্ম বিশ্বাস কে গভীর ভাবে গ্রহণ করতে পারে নি। তার হৃদয়ের সুকোমল বৃত্তি নবকুমারকে কাপালিকের হাত থেকে বাচিয়েছিল। তার এই মমতা ও সহজাত অনুভূতি তার চরিত্রের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে লক্ষণীয়।
সামাজিকতার ব্যাপারে কপালকুণ্ডলার তেমন কোন ভাবনা ছিল না। সংসারে এসেও সে নিজেকে সামাজিক করে তুলতে পারে নি। উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডের ৩য় পরিচ্ছেদে মতিবিবি দেওয়া গহনা গুলো অবলীলাক্রমে এক ভিক্ষুক দিতে দেখি। ফলে তার চরিত্রে সামাজিকতার অভাব লক্ষ্য করা যায়।
কপালকুণ্ডলা চরিত্রের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল স্বাধীনতাকামী ও প্রতিবাদী ভূমিকা। বনের পাখির মত কপালকুণ্ডলা ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে। সাংসারিক বন্ধনে সে মোটেই আগ্রহী নয়। শ্যামাসুন্দরীর জন্য ঔষধের খোজে রাতে একাকী বনের মধ্যে প্রবেশ করে। এতে তার কোন প্রকার সংকোচ নেই। অপর দিকে তার স্বামী নবকুমার কতৃক স্বাধীনতার বাধা পেয়ে সে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। আমরা তাকে বলতে শুনি, “ যদি জানতাম যে, স্ত্রীলোকের বিবাহ দাসীত্ব, তবে কদাপি বিবাহ করিতাম না”।
ধর্মীয় সংষ্কার কপালকুণ্ডলা চরিত্রের আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। উপন্যাসের ১ম খণ্ডের ৭ম পরিচ্ছেদে নবকুমারের সাথে কপালকুণ্ডলার বিবাহ হয় এবং তার পরদিন মেদিনীপুরে আগমন পূর্বক ভবিষ্যত শুভাশুভ জানার জন্য দেবী চরণে বিল্বপত্রাপর্ণ দান করলে তা চ্যুত হয়ে পড়ায় সে বুঝতে পারে এ যাত্রায় দেবীর সম্মতি নেই। এখানে আমরা তার ধর্মীয় ভক্তি প্রবণ হৃদয়ের প্রমাণ পাই।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের সমাজ ক্লিক করো
কপালকুণ্ডলার চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তার সারল্য, সংকোচশূন্যতা, ভক্তিপরয়নতা, নিঃস্বার্থপরতা, অনুকম্পা এবং শুচিতা বা পবিত্রতা,প্রকৃতির স্বভাব বৈশিষ্ট্যের ভিন্নরূপ। স্বভাব স্বাধীন কপালকুণ্ডলার বন্য প্রকৃতিতে “বনোন্মত্তা”“বোধ করি, সমুদ্রতীরে সেই বনে বনে বেড়াইতে পারিলে আমার সুখ জন্মে”।
বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের এক ব্যাতিক্রম চরিত্র কপালকুণ্ডলা। সংসার জীবনে প্রবেশের পর তার নূতন নাম হল মৃন্ময়ী। নূতন জীবনে এস তার নামের পরিবর্তন হল এটা ঠিক কিন্তু তার মনের কোন পরিবর্তন হয় নি। আমরা তাকে বলতে শুনি “বোধ করি সমুদ্রতীরে সেই বনে বনে বেড়াইতে পারলে আমার সুখ জন্মে’। এই উপন্যাসের ৪র্থ খণ্ডের শেষ পরিচ্ছেদে আমরা দেখতে পাই কপালকুণ্ডলা সমুদ্রতীরেই তার আত্মবিসর্জন দেয়।
কবিচিত্তের স্বতঃফূর্ত প্রেরণায় বঙ্কিচন্দ্র
কপালকুণ্ডলাকে অদৃষ্টের অনুগামী করেছেন। দস্যু কতৃক পরিত্যাক্ত অরণ্যময় জীবনে, কাপালিক
সংসর্গে, নবকুমারের সাথে পরিচয়, বিবাহ ও সংসার জীবনে তার জীবন চক্রের প্রতিটি স্তরে
দৈব শক্তির প্রভাব অনিবার্য। তার জীবন ট্র্যাজেডির শেষপর্ব ঈশ্বর নির্দেশিত পথেই পরিসমাপ্ত
হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কপালকুণ্ডলা বঙ্কিমের এক অপূর্ব সৃষ্টি।