তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙল,
ব্যাখ্যা: এদেশের নারীরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য স্বাধীনতার পক্ষের লোক ছিল সাকিনার স্বামী। মুক্তিযুদ্ধে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ফলে সহায়-সম্বল সম্ভ্রম হারিয়ে কপাল ভেঙেছে সাকিনা বিবির।
সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।
ব্যাখ্যা: স্বামীর মঙ্গলের জন্য সনাতন ধর্মের অনুসারী নারীরা বিয়ের পরে মাথায় সিঁদুর পরে। বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য হাসিমুখে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন লাখো মানুষ, পেয়েছেন শহীদের মর্যাদা। ঠিক তেমনি হরিদাসীর স্বামীও স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আর তারই জন্য হরিদাসীর সিঁথির সিঁদুর মুছে গিয়েছে।
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিৎকার করতে করতে
ব্যাখ্যা: পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে বদ্ধপরিকর বাঙালিদের দমিয়ে রাখতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শহরে ট্যাঙ্ক নামিয়েছিল। ট্যাঙ্ক থেকে বিকট শব্দে নির্গত হচ্ছিল গোলা। সেই শব্দকে কবি বলেছেন দানবের মত বিকট চিৎকার।
বঙ্গবাণী কবিতার ব্যাখ্যা জানতে ক্লিক করুনএখানে
তুমি আসবে বলে, হে
স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড হলো। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটাল যত্রতত্র।
তুমি আসবে বলে ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
ব্যাখ্যা: পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এমন ভাবে সব পুড়িয়ে ফেলে এতে গ্রামের
পর গ্রাম যেন একেবারে ছাইয়ে পরিণত হয়ে যায়।
তুমি আসবে বলে বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁডিয়ে একটানা আর্তনাদ করল একটা কুকুর।
ব্যাখ্যা: নিরীহ প্রাণীর প্রভু বিয়োগের কুরণ আর্তনাদ কবি নির্মম ভাবে তুলে ধরেছেন। পাক হানাদার বাহিনীর ধ্বংসলীলায় ভগ্নস্তুপে পরিণত হয় বাংলার প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি শহর। ধ্বংসযজ্ঞের শিকার কোনো নিরীহ বাঙালির বাস্তুভিটায় দাঁদিয়ে প্রভুভক্ত কুকুর তার মনিবের জন্য আর্তনাদ করে।
তুমি
আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুডি দিলো পিতা-মাতার লাশের উপর।
ব্যাখ্যা: কবি এই চরণে পাকিস্তানি
হানাদার বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ইঙ্গিত দিয়েছেন। পাকিস্তানি হায়েনাদের হত্যাযজ্ঞের
তালিকা থেকে বাদ যায় নি কেউই। হয়তোবা কোমলমতি কোনো শিশুর বাবা মাকে নির্মম ভাবে হত্যা
করেছে পাক হানাদার বাহিনী। কিন্তু সেই নারকীয়তা বোঝার ক্ষমতা শিশুটির এখনো হয়নি। অবুঝ
শিশু তার বাবা মায়ের লাশের উপর দিয়েই হামাগুড়ি দিয়েছে।
কপোতাক্ষ নদ কবিতার ব্যাখ্যা জানতে ক্লিক করো এখানে
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
ব্যাখ্যা: মুক্তিকামী বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীনতা ছিল
সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত বিষয়। প্রতিটি মানুষের মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে এই বাংলায় স্বাধীনতা
একদিন আসবেই। কোনো এক থুত্থুড়ে বুড়ো সেই আশায় বসে আছেন। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়লেও স্বাধীনতার
স্বাদ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল তার মন। অপরাহ্ণের দুর্বল আলো বলতে কবি বৃদ্ধের জীবনের শেষ
সময়ের কথা বুঝিয়েছেন। স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল বৃদ্ধের মনে শেষ বিকেলের আলো আশার সঞ্চার
করেছে।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
মোল্লাবাডির এক বিধবা দাঁডিয়ে আছেনড়বড়ে খুঁটি ধরে দগ্ধ ঘরের।
ব্যাখ্যা: পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের শিকার
মোল্লাবাড়ির এক সদ্য বিধবা ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ির খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আগুনে পুড়ে যাওয়া
বাড়ি ও সদ্য বিধবার ভাগ্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই কেননা দুইটি সত্তাই নির্মমতার
স্বীকার।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুড়ো
উদাস দাওয়ায় বসে আছেন – তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের
দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে চুল।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
বসে আছে পথের ধারে।
ব্যাখ্যা: স্বাধীনতার জন্য কত বাবা-মা হারিয়েছেন তাদের প্রিয় সন্তান। একইভাবে কত সন্তান হারিয়েছে তাদের প্রিয় বাবা-মাকে। অসহায় এসব শিশু দারিদ্র্যের কষাঘাতে হাড্ডিসার। তারা পথের ধারে শূন্য থালা হাতে অপেক্ষায় বসে আছে তাদের অধিকার কখন তারা ফিরে পাবে।
মানুষ কবিতার ব্যাখ্যা জানতে ক্লিক করো এই লিঙ্কে
তোমার জন্যে,
সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্ট দাস, জেলেপাডার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী বলে যে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝড়ে,
ব্যাখ্যা: পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে ও বেয়োনেটের আঘাতে অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে। শাহবাজপুরের জোয়ান কৃষক সগীর আলী, জেলেপাড়ার দুর্দান্ত সাহসী লোক কেষ্ট দাস এদেরকে হানাদাররা হত্যা করেছে। মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি মতলব মিয়া জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পারাপার করেছে, নিজের জীবন দিয়ে তাদেরকে বাঁচিয়েছে। তাকে হত্যা করেছে দানবরা
রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
ব্যাখ্যা: স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রিকশাওয়ালা রুস্তম শেখ অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে সে শহীদ হয়। মাটির নিচে রুস্তম শেখের ফুসফুসে হয়তোবা এখন পোকার বসবাস। কিন্তু রুস্তম শেখের মত লাখো মানুষের আত্মত্যাগে অর্জিত হয়েছে আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
আর
রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুরে-বেড়ানো
সেই তেজি তরুণ যার পদভারে
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।
ব্যাখ্যা: বাংলার দামাল তরুণেরা অস্ত্র হাতে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। স্বাধীনতার দাবি আদায়ে বদ্ধ পরিকর দামাল তরুণদের প্রতিবাদী সংগ্রাম ও উদ্দামতাই পৃথিবী থেকে সকল অন্যায় অবিচার, নির্মমতা দূর করে নির্মল এক পৃথিবীর জন্ম দিবে-এটাই স্বপ্ন দেখেন কবি।
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,
ব্যাখ্যা: স্বাধীনতার ধ্বনি প্রতিটি বাঙ্গালির মনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের মনে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে স্বাধীনতাকামীরা স্বাধীনতা পাবার প্রত্যাশায় ব্যাকুল হয়ে আছে।
নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।
ব্যাখ্যা: স্বাধীনতা লাভের দৃঢ় প্রত্যয় কবি এই চরণে ব্যক্ত করেছেন। বাঙ্গালির মুক্তিকামী চেতনা তাকে বিশ্বদরবারে পরিচিতি দিয়েছে। বাঙ্গালির মুক্তিকামী মানসিকতার বদৌলতে স্বাধীনতা ভিন্ন অন্য কোনো বিকল্প এই ভূমিতে নেই। স্বাধীনতা অর্জন এখন শুধু মাত্র সময়ের ব্যাপার। এই দেশ স্বাধীনতা অর্জন করবেই ।
স্বাধীনতা এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো কবিতার ব্যাখ্যা এখানে