রানার কবিতার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ
রানার ছুটেছে তাই ঝুম্ঝুম্ ঘন্টা
বাজছে রাতে
রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে,
রানার চলেছে, রানার !
রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার ।
দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার-
কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।
ব্যাখ্যা: ইংরেজি শব্দ Runner যার আভিধানিক অর্থ যিনি দৌড়ান। এখানে ডাক হরকরা
অর্থে রানার শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ, যিনি মানুষের কাছে চিঠি পৌঁছে দেন। মানুষের
জীবনের সুখ-দুঃখের নানা সংবাদের বোঝা কাঁধে নিয়ে ডাক বাহক ছুটে চলে রাতের অন্ধকারে।
কারো কোন নিষেধ মানে না সে, মানুষের জীবনের নতুন নতুন সংবাদ বহনের কাজের জন্য তাকে
দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছুটে বেড়াতে হয়। এজন্যেই রাতের বেলাতেও সে পথে পথে ছুটে চলে।
রানার! রানার!
জানা-অজানার
বোঝা আজ তার কাঁধে,
বোঝাই জাহাজ রানার চলেছে চিঠি আর সংবাদে;
রানার চলেছে, বুঝি ভোর হয় হয়,
আরো জোরে, আরো জোরে হে রানার দু্র্বার দুর্জয়।
ব্যাখ্যা: রানার জানা-অজানার বহু সংবাদ কাঁধে ছুটে চলে। তার পিঠে সংবাদের বোঝা
দেখে কখনওবা বোঝাই জাহাজ এর মত মনে হয়। রানার দুর্বার গতিতে ছুটে চলে। ‘দুর্বার’ শব্দের
অর্থ যাকে নিবারণ করা যায় না। তার মনে আশঙ্কা- এই বুঝি রাত শেষ হয়ে ভোর হল! সে আরো
জোরে ছুটতে থাকে। তার চলার সেই গতি দুর্বার, দুর্জয়।
কপোতাক্ষ নদ কবিতার বিশ্লেষণমূলক ব্যাখ্যা এই লিঙ্কে
তার জীবনের স্বপ্নের মতো পিছে সরে যায় বন,
আরো পথ, আরো পথ – বুঝি লাল হয় ও পূর্ব কোণ ।
অবাক রাতের তারারা, আকাশে মিট্মিট্ করে চায়;
কেমন করে এ রানার সবেগে হরিণের মতো যায় !
কত গ্রাম, কত পথ যায় স’রে স’রে –
শহরে রানার যাবেই পৌঁছে ভোরে;
হাতে লন্ঠন করে ঠন্ঠন্, জোনাকিরা দেয় আলো
মাভৈঃ রানার ! এখনো রাতের কালো ।
ব্যাখ্যা: রানারের চলার দুর্বার গতিতে পথের ধারের বন পিছনে চলে যায়। এ যেন রানারের জীবনের স্বপ্নের মতো পিছে পড়ে থাকা। রানার ছুটেছে, তার সামনে আরো অনেকটা পথ বাকি। অথচ, পূর্বকোণ লাল হয়ে এসেছে, আকাশের তারাটা মিটমিট করে জ্বলছে। রানার হরিণের মত ছুটে চলছে গন্তব্যের দিকে। হরিণ (যেমন) নিঃশব্দে দ্রুত দৌড়ায়, ঠিক একইভাবে দৌড়ায় রানার, তাই এই উপমাটি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। তার চলার পথের পাশে গ্রামগুলো সরে সরে যায় সেদিকে তার খেয়াল নেই, তাঁর লক্ষ্য ভোরের মধ্যেই তাকে শহরে পৌঁছাতে হবে। তার হাতের হারিকেনের তেল ফুরিয়ে আসে, জোনাকিরা আলো জ্বেলে দেয়, কিন্তু তখনও রাতের অন্ধকার শেষ হয়নি। এমন পরিবেশের মধ্য দিয়ে রানার ছুটে চলে।
এমনি ক’রেই জীবনের বহু বছরকে
পিছু ফেলে,
পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে ‘মেলে’।
ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে
জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে।
অনেক দুঃখে, বহু বেদনায়, অভিমানে, আনুরাগে,
ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে।
ব্যাখ্যা: রানার নতুন সংবাদের বোঝা কাঁধে নিয়ে গ্রামের মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর
পেছনে ফেলে শহরের পানে ছুটে চলে। ঠিক এভাবেই জীবনের বহু বছর ধরে বহু চাওয়া-পাওয়ার
আশা, স্বপ্ন পেছনে ফেলে ক্ষুধিত রানার মানুষের কাছে সংবাদ পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে। নিজের
পৃথিবীর বোঝা হয়ে থেকেছে, তার ক্লান্ত নিঃশ্বাস আকাশ ছুঁয়েছে, তার শরীরের ঘামে মাটি
ভিজেছে। জীবনের সব আশা, স্বপ্নকে সামান্য মূল্যে বিক্রি করেছে রানার। ছুটেছে পথে পথে
আর ঘরে প্রিয়া বেদনায়, অভিমানে, অনুরাগে তার অপেক্ষায় নির্ঘুম রাত পার করে।
তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা কবিতার ব্যাখ্যা এখানে
রানার! রানার!
এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে?
রাত শেষে হয়ে সূর্য উঠবে কবে?
ব্যাখ্যা: রানার জানেনা এ বোঝা টানার দিন তার কবে শেষ হবে। রাতের আঁধার
কেটে কখন তার জীবনে সূর্য উঠবে সেটাও তিনি জানে না।
ঘরেতে অভাব; পৃথিবীটা তাই মনে
হয় কালো ধোঁয়া,
পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া,
রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে,
দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে।
কত চিঠি লেখে লোকে –
ব্যাখ্যা: ক্লান্ত বিষন্ন রানারের জীবন খুবই দরিদ্র। তার ঘরে অভাব, দারিদ্র্যে
জর্জরিত পৃথিবীটা তার কাছে কালো ধোঁয়ার মতো মনে হয়। সে প্রতিনিয়ত টাকার বোঝা পিঠে
বহন করে নিয়ে যায় অথচ সেই টাকা সে ছুঁয়ে দেখতে পারে না। নির্জন রাতে সেই বোঝা নিয়ে
ছুটে চলে আর পথে নানা রকম ভয় তাকে তাড়া করে। তবুও সে থামে না, সে ছুটে চলে নিজের মত।
পথে ডাকাতের আক্রমণের ভয়ের চেয়েও তার বড় ভয় সূর্য ওঠা। কারণ সূর্য ওঠার আগেই তাকে
শহরে পৌঁছে যেতে হবে।
কত সুখে, প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে,
কত দুঃখে ও শোকে ।
এর দুঃখের চিঠি পড়বে না জানি কেউ কোনো দিনও,
এর জীবনের দুঃখ কেবল জানবে পথের তৃণ,
এর দুঃখের কথা জানবে না কেউ শহরে ও গ্রামে,
এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই কালো রাত্রির খামে।
ব্যাখ্যা: বিভিন্ন রকমের চিঠি মানুষ লিখে থাকে। সুখ-দুঃখ, প্রেম, আবেগ-অনুভূতির
নানা কথা থাকে এসব চিঠিতে। শোকের সংবাদ থাকে কেবল রানারের জীবনের কোনো চিঠি থাকে না।
কবি জানেন রানারের নিজের জীবনের দুঃখের চিঠি কেউ কোনদিন লিখবেনা, পড়বেও না। তার কথা
কেউ মনেও রাখবে না। তার জীবনের দুঃখ বেদনার কথা কেবল পথের তৃণের কাছে পড়ে থাকবে। তাছাড়া
শহর ও গ্রামের কেউ জানবে না তার কথা। কাল রাতের আঁধারের খামে ঢাকা পড়ে থাকবে রানারের
জীবনের গল্পগুলো।
মানুষ কবিতার বিশ্লেষণমূলক ব্যাখ্যা এখানে
দরদে তারার চোখ কাঁপে
মিটিমিটি, –
এ-কে যে ভোরের আকাশ পাঠাবে সহানুভূতির চিঠি –
রানার ! রানার ! কি
হবে এ বোঝা বয়ে?
কি হবে ক্ষুধার ক্লান্তিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে?
রানার ! রানার ! ভোর তো হয়েছে – আকাশ হয়েছে লাল
আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল?
ব্যাখ্যা: রানারের ক্লান্ত, বিষন্ন, দুঃখময় জীবনের প্রতি প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ
ব্যথিত। তার দরদে তারার চোখ মিটিমিটি করে কাঁপে। তাকে ভোরের আকাশের আলো সহানুভূতির
সংবাদ পাঠাবে। তারা জিজ্ঞেস করবে কী হবে এ বোঝা বয়ে, কী হবে ক্ষুধার ক্লান্তিতে নিজেকে
নিঃশেষ করে দিয়ে। তারা রানারকে ডেকে বলে, রানার, ওই দেখো দূর আকাশে লাল হয়ে সূর্য
উঠেছে। এখানে যদিও আকাশে লাল হয়ে সূর্য উঠেছে বলতে বাচ্যার্থে অন্ধকার শেষ হয়ে আকাশে
সূর্য উঠার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু, যেই অর্থটি কবি বুঝাতে চেয়েছেন সেটি আসলে একটি
প্রতীকী অর্থ। অর্থাৎ, ‘আকাশ হয়েছে লাল’ এই অংশটির দ্বারা কষ্টের কালিমা দূর হয়ে
সুখের সোনালী আলো দেখা দিচ্ছে, এমন একটা ভাবই বোঝাতে চেয়েছেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য।
রানার! গ্রামের
রানার!
সময় হয়েছে নতুন খবর আনার;
শপথের চিঠি নিয়ে চলো আজ
ভীরুতা পিছনে ফেলে –
পৌঁছে দাও এ নতুন খবর,
অগ্রগতির ‘মেলে’,
ব্যাখ্যা: দুঃখ, দারিদ্র্য রানারের জীবনের নিত্য সঙ্গী। তবু সে নতুন খবর আনার
জন্য ছুটে চলে। আজ আর সূর্য ওঠার ভয় নয়, শহরের খবর পৌঁছে দেয়া নয়। অগ্রগতির মেলে
আজ জীবনের খবর পৌঁছে দেয়ার পালা। তাই সমস্ত ভীরুতা পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার
সংবাদ আছে এমন শপথের চিঠি রানার কে পৌঁছে দিতে হবে। যারা অল্প দামে তার জীবনের মূল্যবান
রাতগুলো কিনে নিয়েছে, তাদের মুখোমুখি দাঁড়ানোর প্রতিকারের চেতনাসমৃদ্ধ চিঠি রানার
বহন করে আনবে
দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি
–
নেই, দেরি নেই আর,
ছুটে চলো, ছুটে চলো আরো বেগে
দুর্দম, হে রানার ॥
ব্যাখ্যা: সেই সময় আর খুব বেশি দূরে নয়, অপেক্ষার কাল অবসান হয়েছে। আরো
বেগে ছুটে চলা রানার সেই সময়কে সামনে নিয়ে আসবে। তাই দুর্দম তার পথচলা..
বঙ্গবাণী কবিতার বিশ্লেষণমূলক ব্যাখ্যা এখানে
Much helpful👌
উত্তরমুছুন