ট্রাজেডির সংজ্ঞার্থ ও প্রকৃতি

 


 


প্রশ্ন 
এ্যারিস্টটলের মতে ট্রাজেডির সংজ্ঞার্থ ও প্রকৃতি আলোচনা কর । 

আত্মদ্বন্দ্বে পরাভূত মানবাত্মার করুণ কাহিনীর শিল্পায়নকে সাধারণভাবে ট্রাজেডি বা করুণ পরিণতির নাটক বলা হয়। এ ছাড়া ট্রাজেডিকে বিষাদাত্মক এবং বিয়োগাত্মক নাটকও বলা হয়ে থাকে। ইংরেজি শব্দ ট্রাজেডি। গ্রিক শব্দ Tragody থেকে উৎপন্ন। Tragody এর অর্থ হচ্ছে বলি দেয়া ছাগলকে ঘিরে Chorus বা  নৃত্য । এজন্য যে নাটক দুঃখ-বেদনা, ব্যর্থতা-অক্ষমতা, ধ্বংস-মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রস-পরিণতি লাভ করে তাকে ট্রাজেডি বলে ।

Aristotle এর মতে

       Tragedy is an imitation that is serious. complete, and of a certain magnitude; in language embellished with each kind of artistic ornament, the several kinds being found in separate parts of the play; in the form of action, not of narrative, through pity and fear effecting the proper purgation of these emotions.

ট্রাজেডির প্রথম রূপকার এরিস্টটলের মতে ট্রাজেডি চার প্রকার ১. কমপেন্টকস্ ২. প্যাথেটিক ৩.এথিক্যাল ৪.  সিমপলস ।

কমপেন্টকস ট্রাজেডি : ঘটনার বৈপরীত্য এবং প্রত্যভিজ্ঞান প্রভৃতি বিস্ময়জনক ঘটনার প্রাচুর্যে ভয়ানক ও করুণ রসের  সংমিশ্রণের এবং অদ্ভূত রসের আধ্যিককে যে ট্রাজেডি নাটক সৃষ্টি হয়, তাকে জটিল ট্রাজেডি বলা হয়। এ শ্রেণীর নাটক কে এরিস্টোটল উত্তম ট্রাজেডি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন । 

প্যাথেটিক ট্রাজেডি: বিক্ষোভ ও বিলাপ প্রকাশের মাধ্যমে গভীরতর বেদনা সৃষ্টি করাকে প্যাথেটিক ট্রাজেডি বলে। এ নাটকে করুণার আধিক্যের সঙ্গে ট্রাজিক- ইম্প্রেসন ও যথেষ্ঠ থাকে ।

এথিক্যাল ট্রাজেডি: যে ট্রাজেডিতে কোনো রসকে পরিণতি দান করা অপেক্ষা কোনো নৈতিক সমস্যা মুখ্য হয়ে ওঠে এবং সে সমস্যাকে শিল্পিত করা হয়, তাকে নৈতিক ট্রাজেডি বলা হয় । এ জাতীয় নাটককে ভাব-রসাত্মাক নাটকও বলা হয় ।

ডসমপল ট্রাজেডি : যে ট্রাজেডিতে পরিস্থিতি বা প্রত্যভিজ্ঞান থাকে না, ঘটনাবিন্যাস জটিল বৃত্তের মত থাকে না, রসগত দিক থেকে প্রথম শ্রেণীর awe and grandeur  থাকে না, প্যাথেটিক ট্রাজেডিসুলভ করুণের প্রাধান্য থাকে না এবং উভয়ই প্রয়োজনীয় মাত্রায় উদ্রিক্ত হয়, তবে তাকে সরল ট্রাজেডি বলে ।

ট্রাজেডির উপাদান ও গঠন : এরিস্টোটলের মতে ট্রাজেডি গুরুগম্ভীর এবং দ্বন্দ্ববিক্ষোভময় ঘটনার action। ঘটনা সংঘটন মূলত ব্যক্তিআশ্রয়ী, কেননা এরিস্টোটল বলেন মানুষের আচরণ বৈশিষ্ট্য তার চরিত্র ও মনন দ্বারা নির্ধারিত এবং শেষ পর্যন্ত ঘটনার বা আচরণের ওপরেই মানুষের জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা নির্র্ভর করে। এরিস্টোটলের মতে ট্রাজেডির উপাদান ছয়টি বৃত্ত

  • চরিত্র
  • ভণিতি
  • মনন
  • দৃশ্য
  • গীত

বৃত্ত : ট্রাজেডি জীবনের রূপ- ঘটনার রূপ । ঘটনার দ্বারাই জীবন পরিণতির দিকে এগিয়ে চলে । জীবনের পরিণাম দেখাতে হলে তাই ঘটনার পর ঘটনা বিন্যাস করেই দেখাতে হবে । চরিত্র ঘটনার জনক হলেও ঘটনাই শেষ পর্যন্ত মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে । সুতরাং ঘটনা-বিন্যাস দ্বারা জীবনের গতিশীল ও ক্রিয়াশীল রূপ তথা একটা রস-বৃত্ত তৈরী করাই সর্বপ্রধান কাজ ।

চরিত্র: পরিপাটি ঘটনা-বিন্যাসের সঙ্গে সুক্ষ্ম চরিত্র নির্মাণে যথার্থ ট্রাজেডি সম্ভব । কেননা আগেই বল হয়েছে ট্রাজেডি ঘটনার জনক।

ডিকসান: পাত্র-পাত্রীর মুখে চরিত্র ব্যঞ্জক সুন্দর সুন্দর ভাব-ভাষা সংযোজনের মাধ্যমে ঘটনা নিমিতি পেলে সার্থক ট্রাজেডি সৃষ্টি হয়।

মনন: সুপরিকল্পিত চিন্তার অবকাশ থাকলে যথাযথ চরিত্র নিমার্ণ ও পরিপাটি বৃত্ত গঠনের মাধমে ট্রাজেডি সম্ভব।

দৃশ্য: দৃশ্য সজ্জা নাটকে রস সৃষ্টির অন্যতম উপায়। নাটক জীবনের প্রত্যক্ষ রূপ,পাত্র-পাত্রীর ক্রিয়া-কলাপের উপস্থাপনা, সুতরাং  Ò Spectacular equipment will be a part of Tragedy”

গীত: গানকে ট্রাজেডিতে এরিস্টোটল প্রধান Ô embellishment Õ হিসাবে গণ্য করেছেন। সুপ্রযুক্ত গান অন্যতম উপাদান হিসাবে ট্রাজেডিতে স্থান পেতে পারে ।

ট্রাজেডির গঠন:- ট্রাজেডির গঠন সম্পর্কে ঘটনা-বন্ধ এবং ঐক্যের প্রশ্নই প্রধান আলোচ্য বিষয়। ঘটনা-বন্ধ বলতে বুঝায় বৃত্তে ঘটনার বাঁধুনি বা বিন্যস-রীতি। এরিস্টটল বৃত্তকে মোটামুটি দুই শ্রেণীকে ভাগ করেছেন:  সরল ও জটিল। সরল বৃত্ত হচ্ছে সেই বৃত্ত, যাতে ঘটনা পর পর ঘটে যায় । কেনো কার্যকরণ যোগ থাকে না এবং ”রিভার্সাল অব্ সিচুয়েশান” বা “ডিসকভারি ” প্রভৃতি  থাকে না ; আর জটিল হচ্ছে -এর বিপরীত অর্থাৎ যাতে ঐ দুয়ের একটা বা দুটোই থাকে এবং ঘটনা-বিন্যাসের মধ্যে কার্যকারণ নিয়মের জমাট বাধুনি থাকে। জটিল বৃত্তই  হচ্ছে আদর্শ বৃত্ত। এই বৃত্তকে বলা হয় জৈবিক, সরল বৃত্তকে বলা হয়-“এপিসোডিক। বৃত্তের একদিকে আদর্শ গঠনের উৎকৃষ্ট রূপ, অন্যদিকে এপিসোডিকের শিথিলবদ্ধ অপকৃষ্ট রূপ। এ দুই মেরুর মাঝে বৃত্তের নানারূপ গঠন সম্ভব ।  

নাটকের ঐক্য:

সময়ের ঐক্যঃ- নাটকীয় আখ্যানভাগ রঙ্গমঞ্চে দেখাতে যতক্ষণ সময় লাগে, বাস্তব জীবনে সংঘটিত হতে যেন ঠিক ততক্ষণ লাগে,এ দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এরিস্টটল এ কাল-নির্দেশ  করতে গিয়ে এতে Ô single revolution of the sun’ অর্থাৎ ২৪ ঘন্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছেন।

স্থানের ঐক্যঃ- নাটকে এমন কোনো স্থানের  উল্লেখ থাকতে পারবে না, যেখানে নাট্য-নির্দ্দেশিত সময়ের মধ্যে নাটকের কুশীলবগণ যাতায়াত করতে পারে না ।

ঘটনা ঐক্যঃ- নাটকে এমন কোনো দৃশ্য বা চর্ত্রি সমাবেশ থাকবে না, যাতে নাটকের মূল সুর ব্যাহত হতে পারে। সমস্ত চরিত্র ও দৃশ্যই নাটকের মূল বিষয় ও সুরের পরিপোষক রূপে প্রদর্শিত হওয়া চাই এবং নাটকটি যেন আদি, মধ্য ও অন্ত-সমন্বিত একটি অখণ্ড সৃষ্টি রূপে পরিস্ফুট হয়।

      এরিস্টটল নিজে সময়ের ঐক্য সম্বন্ধে উল্লেখ করলেও স্থানের ঐক্য সম্বন্ধে তিনি কিছু বলেন নি । তিনি ঘটনার ঐক্যের ওপরই জোর দিয়েছেন ।

     ট্রাজেডির সংজ্ঞা বিশ্লেষণে নিম্নরূপ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় :-

বিষয়বস্তু : ট্রাজেডি বিষয় সংক্ষেপে বললে- “actions which excite pity and fear” আরো সংক্ষেপে Ô action that is serious’ অর্থাৎ মানুষের মনে ভয় ও করুণার উদ্রিক্ত করতে সক্ষম। এরিস্টটল নিজেই Ò the circumstances which strike us as terrible or pitiful Ó Ò the circumstances which strike us as terrible or pitiful Ó নির্ধারিত করতে চেষ্টা করেছেন । তিনি বলেছেন, পরস্পর দুই শত্রুর মধ্যে যখন একে অন্যকে হত্যা করে, তখন হত্যা ব্যাপারে এবং হত্যার উদ্দেশ্যে শোচনীয় বলে কিছু থাকে না, শুধু যন্ত্রণা যতটুকু শোচনীয় হয়, ততটুকুই তাতে শোচনীয়ত্ব। আবেগ ও আকর্ষণের গতিবেগ যেখানে বেশী, সেখানে আহত আবেগের ও বিকর্ষণের প্রতিক্রিয়ার তীব্রতাও বেশী। এসব ‘সিরিয়াস এ্যাকশন-ট্রাজেডির বিষয়।

নায়ক: ট্রাজেডি জীবনের ‘সিরিয়াসঅর্থাৎ গভীরভাবাবেগ সংক্ষুব্ধ রূপের অনুরূপায়ণ। সুতরাং ট্রাজেডির নায়ককে অবশ্যই ‘সিরিয়াস মহিমা সম্পন্ন হতে হবে। অর্থাৎ ট্রাজেডির নায়কের গৌরব ,গুরুত্ব¡ ও চিত্তার্কষকত্ব থাকতে হবে। ট্রাজেডি নায়ককে সর্বজন পরিচিত ও ঐশ্বর্যশালী ব্যক্তি হতে হবে। নায়ক প্রখ্যাতবংশ না হলেও তাকে সদ্বংশজাত ও ধীরোদাত্ত হতে হবে। এটিই এরিস্টটলের অভিমত ।

রস: ট্রাজেডিতে pity অপরিহার্য উপাদান হলেও ভাবের মাত্রা-তারতম্যে ট্রাজেডির  রসের প্রকৃতিতে  বৈচিত্র্য সম্ভব এবং সে সর্ম্পকে এরিস্টটল সচেতন। ট্রাজেডির মোট ভাব তিনটি- ভয়, শোচনা ও বিস্ময়। এ তিনটি ভাবের সমন্বয়ে ট্রাজেডির রস নিস্পন্ন হয়। এদের মাত্রা তারতম্যে রসের প্রকৃতিতে বৈচিত্র্য দেখা যায়।

পরিণাম: ট্রাজেডির পরিণাম সর্ম্পকে এরিস্টটলের সিদ্ধান্ত খুব স্পষ্ট। ট্রাজেডি বলতে সাধারণত বিয়োগান্ত নাটককে বোঝায়। গ্রিক ট্রাজেডিতে জীবনের দ্বন্দ্ব দুর্ভোগ ও মৃত্যুর করুণ রূপ উপস্থাপিত হয়ে পরিণামে সে সব দ্বন্দ্ব প্রশমিত হয়েছে। কিন্তু এরিস্টটলের মতে unhappy ending = right ending .


  • রুপসী বাংলা কাব্যে জীবননান্দের মৃত্যুচেতনাএইখানে
  • রুপসী বাংলা কাব্যে জীবননান্দের প্রকৃতিচেতনা এইখানে


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন