প্রশ্নঃ- রূপসী বাংলা কাব্যে অবলম্বনে জীবনানন্দের মৃত্যু চেতনা আলোচনা কর।
বিশ শতকের জটিল মনের আশ্চর্য প্রতীক জীবনানন্দ
দাশ। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় যাঁরা রবীন্দ্রনাথের পরও নতুন কথা নতুন ভাবে বলা যায়
এ-কথা ভেবেছিলেন জীবননান্দ দাশ তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের
উজ্জ্বল বিশ্বাস ও শ্রান্তিহারক আশাবাদ জীবননান্দের ছিল না, ছিল আশাভঙ্গের নিদারুণ
আক্ষেপ। কারণ তিনি যে যুগের মানুষ সে যুগে-আশা ছিল না, ছিল আশাভঙ্গের নিদারুণ আক্ষেপ।
আর তাই তাঁর কাব্যে মৃত্যু চেতনা অধিক স্পষ্ট।
ক্লান্তি ও মৃত্যু চেতনা জীবনানন্দ তথা
আধুনিক কবিতার অন্যতম মূল সুর। এলিয়টের কাব্যেও মৃত্যু চেতনা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। এই
মৃত্যু চেতনা অনেক সময় দৈহিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে জাগ্রত হয় নি। যুগের বন্ধ্যা রূপ,
জীবনের অচরিতার্থতা এবং আর এক সমৃদ্ধতর, পূর্ণতর জীবনের আশা সবই মিশ্রিত হয়ে আছে এর
মধ্যে। আমাদের আধুনিক কবিরা সবকিছুকেই শরীরী করতে চেয়েছেন তাই মৃত্যু চেতনাও জীবনানন্দের
কাব্যে প্রধানত দেহকে অবলম্বন করে প্রকাশ পেয়েছে। কবি জানেন তাঁর পরিচিত জগৎ নষ্ঠ হয়ে
গেছে।
আমরা মধ্যম পথে বিকেলের ছায়ায়
রয়েছি
একটি পৃথিবী নষ্ট হয়ে গেছে
আমাদের আগে
আরেকটি পৃথিবী নিতে গেলে
লাগে
সকালের আকাশের মতন বয়স।
‘রূপসী বাংলা’ কাব্যে এসে এই মৃত্যু চেতনা আরো স্পষ্ট। এ গ্রন্থের
প্রত্যেকটি কবিতা মৃত্যু চেতনায় আচ্ছন্ন। রূপকথা, ইতিহাস, প্রকৃতি যেখান থেকেই তিনি
চিত্রকল্প নিয়েছেন তাই ফুটিয়েছে এক মৃত বাংলার রূপ। ভাঙ্গা ঘাট, মজাদীঘি, জীর্ণবট সবই
এক শ্মশানের দেশের প্রতিচ্ছবি। সেখানে শঙ্খমারা, চন্দ্রমালার কাঁকন আর বাজে না, গাঙুরের
জলে বেহুলার ভেলা আর ভাসে না, চাঁদ সওদাগরের মধুকর কালীদহের ঝড়ে পড়ে না, আর শোনা যায়
না সীতারাম রাজারাম রামনাথ রায়ের অশ্বক্ষুরধ্বনি।
বেহুলাও একদিন গাঙ্গুরের
জলে ভেলা নিয়ে-
কৃষ্ণাদ্বাদশীর দিন জ্যোৎস্না
যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায়-
সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য
অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়,
শ্যামার নরম গান শুনেছিল-একদিন
অমরায় গিয়ে
ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে
নেচিছিল ইন্দ্রের সভায়
বাংলার নদী মা ভাঁট ফুল ঘুঙুরের
মতো তাঁর কেঁদেছিল পায়।
অথবা
আসিয়াছে চণ্ডীদাস- রামপ্রসাদের
শ্যামা সাথে সাথে তার
শঙ্খমালা, চন্দ্রমালা মৃত
কত কিশোরীরর কঙ্কণের স্বর।
জীবনজ্বর-প্রসূত অবসাদের পরিণতি পলায়ন
ও মৃত্যু চেতনা। জীবনানন্দকে এজন্য ঠিক সড়ৎনরফ কবি বলা চলে না। কারণ যে যুগের তিনি
মানুষ-তারই সমাধি তিনি দেখেছেন এবং বলতে গেলে, সে তাঁর এক প্রকার আত্মিক মৃত্যু। জীবনের
প্রতি তাঁর আসক্তি ও আকর্ষণেরই একদিক এই মৃত্যুচেতনা।
আমি চলে যাব বলে
চতাল ফুল কি আর ভিজিবে না আর শিশিরের
জলে
নরম গন্ধের ঢেউয়ে?
লক্ষ্মীপেঁচা গান গেয়ে নাকি তার লক্ষীটির
তরে?
‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের কবিতা গুলিতে কবি মৃত্যু ও জীবনসন্ধির টানাপোড়েনের
রূপ আরো মূর্ত হয়ে উঠেছে। ‘যেদিন সরিয়া যাবো’ কবিতায় কবির মৃত্যু-চেতনা বাসা বেঁধেছে। বাংলার রূপময়
প্রকৃতির হাতেই যেন তার মৃত্যু হয় এই কামনা। মৃত্যু পরবর্তী জীবনেও কবি পড়ে থাকবে বাংলার
প্রকৃতির মধ্যে। কবির যেমন জীবনের উত্থান তেমনি বিলয়ের মধ্যেও কবি আনন্দ খুঁজতে চান।
“কোনদিন রূপহীন প্রবাসের পথে
বাংলার মুখ ভুলে খাচার ভিতরে
নষ্ট শুকের মতন
কাটাইনি দিন মাস,”
অথবা ‘রূপসী বাংলার’, ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতাটিও
স্মরণ করা যেতে পারে-
আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির
তীরে-এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়-হয়তো বা শঙ্খচিল
শালিকের বেশে
এছাড়াও মৃত্যু চেতনা প্রধান আরো কয়েকটি
কবিতা হলো, ‘ঘুমায়ে পড়িব আমি’, ‘যখন মৃত্যুর ঘুমে’, ‘আমি যদি ঝরে যাই’ ইত্যাদি অন্যতম।
“আনারস
ফুলে
ভোমরা উড়িছে, শুনি-গুবরে
পোকার ক্ষীণ গুমরানি ভাসিছে বাতাসে
রোদের দুপুর ভরে শুনি : ইহারা
আমায় ভালবাসে-”
- ট্র্যাজেডির সংজ্ঞা ও প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন
- রুপসী বাংলা কাব্যে জীবননান্দের প্রকৃতিচেতনা এইখানে