প্রশ্ন:- ‘রূপসী বাংলা’কাব্যে
কবি জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতি চেতনার বর্ণনা দাও।
এক বিমূঢ় যুগের বিভ্রান্ত কবি জীবনানন্দ
দাশ। পৌষের চন্দ্রালোকিত মধ্যরাত্রির প্রকৃতির মত তার কাব্য কুহেলিকুহকে আচ্ছন্ন। কাব্যে
কবি সমকালীন বিশ্বচৈতন্যে অনুবদ্ধ। হতাশা তাড়িত কবি অনুভব করলেন প্রকৃতি আজ অবক্লিষ্ট
ও উপযোগিতাহীন। পোড়ো জমির চিত্রকল্পে কবি প্রকৃতিকে দেখলেন সৃষ্টি সম্ভাবনাহীন বন্ধ্যারুপে।
জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতি চেতনা ঐতিহ্যবোধের
সঙ্গে অন্বিত। রুপসী বাংলার যুগে বাংলার নিপুণ প্রকৃতিক চিত্রলেখের সংগে এসে মিশেছে
বাংলার রুপকথা ও ইতিহাসের ধূপছায়া। বলা বাহুল্য জীবনান্দনের সমগ্র কাব্যকে যদি আলোচনার
জন্য ভাগ করা হয় কবে তা তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়। তাহল প্রকৃতি, প্রেম আর মানব সভ্যতার
ইতিহাস। যেখানে প্রকৃতির আধিপত্য সেখানে প্রেম ও ইতিহাস চেতনা প্রকৃতিকে জীবন্ত ও ঘনিষ্ঠ
করে তুলে তাকে জড়তার উর্ধ্বে টেনে এনে আমাদের একঘরের বাসিন্দা করে তুলেছে।
আধুনিক যুগে জীবনের মূল্যোবোধগুলি যে
পরিবর্তিত হয়ে গেছে বা যাচ্ছে জীবনানন্দ সে-কথা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তাঁর
মনে হয়েছিল রোমান্টিক ভাবনা দিয়ে বর্তমান যুগস্বরূপকে উদঘাটিত করা যাবে না। তাই তাঁর
“মেঠো চাঁদ” কবিতায় কবির প্রকৃতির উপর কোন নির্ভরতা নেই। মেঠো চাঁদ কবির কাজে রোমান্টিক
আবেগের উৎস নয়। প্রকৃতির মধ্যে নেই প্রেরণা। এই নৈরাশ্য ও নেতিচেতনা থেকে কবি উচ্চারণ
করেছেনঃ
আমি তারে বলি:
ফসল গিয়াছে ঢের ফলি
শস্য গিয়াছে ঝরে কত
বুড়ো হয়ে গেছ তুমি এই বুড়ি
পৃথিবীর মত।
এলিয়টের ‘The Waste Land’এর চিত্রকল্প বর্তমান বন্ধ্যা যুগকে দেখেছিলেন, জীবনানন্দ
দেখেছেন হেমন্তের চিত্রকল্পে আর তাই জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতির বর্ণনায় হেমন্তের আধিপত্য। তার কারণ, হেমন্ত প্রকৃতির বন্ধা রূপের মধ্যে তিনি যুগের বন্ধাত্ব
কে অনুভব করেছেন। আমরা আগেই বলেছি যে যুগের বন্ধ্যাত্বের সংগে তার মানসিকতার আত্মীয়তা
আছে ফলে আবহমান মানব সভ্যতাও তাঁর চোখে একই রূপে প্রতিভাত হয়েছে।
হেমন্ত আসিয়া গেছে; চিলের
সোনালি ডানা হয়েছে খয়েরি;
ঘুঘুর পালক যেন ঝরে গেছে
শালিকের আর নেই দেরি,
হলুদ কঠিন ঠ্যাং উচু করে
ঘুমোবে সে শিশিরের জলে;
ঝরিছে মরিছে সব এইখানে বিদায়
নিতেছে ব্যাপ্ত নিয়মের ফলে।
হেমন্তের আগমনের ফলে ফসলের অবসান হল অর্থ্যাৎ
রোমান্টিক যুগ শেষ হয়ে গেল। চারদিতে জীর্ণতা, জরার, ক্ষয়ের, মৃত্যুর চিহ্ন।
ধূসর
পাণ্ডুলিপিতে জীবনানন্দ যেমন বিনষ্ঠশ্রী হেমন্তের মধ্যে নতুন সৌন্দর্য আবিষ্কার করেছেন
‘রূপসী বাংলায় তেমনই বিধ্বস্ত বাংলার বিষণ্নতার মধ্যে নতুন রূপ ও ঐশ্বর্য বিস্ময়ের
চোখে দেখেছেন। বর্তমান বাংলার ধ্বংস রূপ তিনি দেখেছেন, তার জন্য গভীর বেদনাও অনুভব
করেছেন, তবুও দেশের শ্রীহীনতার মধ্যেও তিনি এমন কিছু সৌন্দর্য আবিষ্কার করেছেন যা দিয়ে
কবিতা লেখা সম্ভব। বাংলাদেশে তথা পূর্ব বাংলার প্রকৃতি তার অশ্বত্থ, বট, তেঁতুল, আম,
জাম, কাঠাল, হিজল গাছ, শালিক, দোয়েল, শ্যামা, চড়াই, ঘুঘু, কাঁচাপোকা, গুবরে পোকা, ফড়িং
সবকিছু যেন আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠেছে।
ক. মধূকর ডিঙা থেকে না জনি
সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে
এমনই হিজল-বট-তমালের নীলছায়া
বাংলার অপরূপ রূপ
দেখেছিল
খ. হলুদ নরম পায়ে খয়েরি শালিক
গুলো ডলিছে উঠান
গ. খড় কুটো উল্টায়ে ফিরিতেছি
দু’একটা চড়াই
অশ্বত্থের পাতা গুলো পড়ে
আছে ম্লান শাদা ধুলোর ভিতর
যুগের তিক্ত অভিজ্ঞতা জীবনানন্দের কবিতায়
সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয়েছে। সেইজন্য তাঁর কবিতায় রবীন্দ্রনাথের মাধুর্য অথবা লালিত্য
নেই, আছে এক অস্থির হৃদয়ের যন্ত্রণাবোধ যা বিষ মাখানো তীরের ফলার মতো পাঠকের বুকে এসে
বিধেঁ যায়, কোনো একদিন হয়তো ক্ষত সেরে যায় কিন্তু সারাজীবনের জন্য অস্থির অস্বস্তি
চোখের ঘুম কেড়ে নেয়। ‘রূপসী বাংলায়’ কবি মানব জীবন সম্পর্কে ক্লান্ত, যুগজ্বরে অবসন্ন।
সম্ভবত এই জন্যই তিনি কমলালেবু, শালিখ বা ভোরের কাক হয়ে নতুন জন্ম নিতে চেয়েছেন। কারণ
প্রকৃতিতেই একমাত্র প্রসন্ন প্রাণস্রোতে বিরাজিত। অশ্রু নেই, প্রশ্ন নেই।
চেয়ে দেখি- ঘুম নাই-অশ্রু
নাই-প্রশ্ন নাই
বটফল গন্ধ মাখা ঘাসে।
এ কাব্যের আরেকটি অন্যতম কবিতা ‘একদিন
জলসিড়ি’। এ কবিতায় কবি বাংলার প্রকৃতির মোহনীয় রূপে মুগ্ধ হওয়ার কথা ব্যক্ত করেছেন
এবং মৃত্যু পরবর্তী সময়েও কবি বাংলার জলসিড়ি নদীর পাশে বাংলার মাঠে বট গাছের নিচে শুয়ে
থাকতে চেয়েছেন যেখানে তাঁর সাথে থাকবে বাঁকা চাঁদ, বটের লাল ফল, বিশালক্ষী মন্দিরের
বাঙালি মেয়ের শব্দ।
“বাঁকা চাঁদ জেগে রবে-নদীটির জলে
বাঙালি মেয়ের মতো বিশালক্ষী
মন্দিরের ধূসর কপাটে
আঘাত করিয়া যাবে ভয়ে ভয়ে।
‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের প্রকৃতি যেন শেষ বিকেলের নরম রোদের ছোয়া। এ
কাব্যে প্রকৃতিকে তিনি ব্যবহার করেছেন বিচিত্র ভাবে। সাধারণ গ্রাম্য মেয়ে গ্রামীণ জীবনের
সামান্য উপাচার্য ধন, নদী, বৃক্ষ, তৃণলতা অসামান্য দক্ষতায় তিনি তুলে ধরেছেন এ কাব্যে।
কবি যেন বাংলার প্রকৃতির মাঝেই তার আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন।
“তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও- আমি এই বাংলার পারে
রয়ে যাব; দেখিব কাঠাল পাতা
ঝরিতেছে ভোরের বাতাশে
দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের
সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে।
ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ
ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে।”
‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের একটি অন্যতম প্রতিনিধিত্বশীল কবিতা ‘আবার আসিব
ফিরে’। এ কবিতায় কবি বাংলার রূপে মুগ্ধ হয়ে আবার এই দেশেই ফিরে আসতে চান পুনর্জন্ম
নিয়ে-বিভিন্ন রূপে ধানসিড়ি নদীটির তীরে। কবি এই বাংলায় কার্তিক নবান্নের দেশে পরবর্তী
সময়ে আসবেন শঙ্খচিল বা কাক বা শালিখের বেশে কিংবা হাঁস হয়ে।
“আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে- এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়-হয়তোবা শঙ্খচিল
বা শালিখের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিক
নবান্নের দেশে।”
‘বাতাসে ধানের শব্দ’ কবিতায় কবি বাতাসে ধানের শব্দ শুনতে পান, যার শরীরে
সোনালি রঙের রোদ মেখে আছে, দেহের প্রথম প্রেমের মতন তার রূপ। নির্জন আমের ডালে হলুদ
পাখির চুপটি করে বসে থাকা। সাথীহীন মাছরাঙাটির নিঃস্বঙ্গ বিচরণ এর সবকিছুই গ্রাম বাংলার
এক নির্সগ আকর্ষণীয় রূপের পরিচয়।
উপোরক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, জীবনানন্দ দাশ অন্তিম প্রত্যয়ে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। তিনি প্রকৃতিকে তাঁর জীবন সত্ত্বা দিয়ে গ্রহণ করেছেন, আর তা প্রকাশ করেছেন সমগ্র কবি সত্ত্বা দিয়ে। প্রকৃতিকে তিনি ব্যবহার করেছেন বিচিত্রভাবে।