মানুষ কবিতার বিশ্লেষণ , ব্যাখ্যা ও মূলভাব

 



মানুষ কবিতায় বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা: 


নাম               : কাজী নজরুল ইসলাম।  

জন্ম তারিখ        : ২৫ মে ১৮৯৯ খ্রি (১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ)

জন্মস্থান           : বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রাম।      

পিতা              : কাজী ফকির আহমেদ্

মাতা              : জাহেদা খাতুন।

শিক্ষাজীবন       

প্রাথমিক শিক্ষা     : গ্রামের মক্তব থেকে প্রাথমিক শিক্ষালাভ।

মাধ্যমিক           : প্রথমে রাণীগঞ্জের সিয়ারসোল স্কুল, পরে মারখুন উচ্চ ইংরেজি স্কুল, সর্বশেষ ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দারিরামপুর স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন।

কর্মজীবন          : প্রথম জীবনে জীবিকার তাগিদে তিনি কবি দলে, রুটির দোকানে এবং সেনাবাহিনিতে যোগদান করেছিলেন। পরবর্তীকালে পত্রিকায় সম্পাদনা, গ্রামোফোন রেকর্ডের ব্যবসায় গান লেখা ও সুরারোপ ও সাহিত্য সাধনা।

জীবনাবসান       : মৃত্যু ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট।

সমাধিস্থান         : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গন।

সাহিত্যকর্ম

কাব্যগ্রন্থ           : অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, ভাঙার গান, সাম্যবাদী, সর্বহারা, ফণি-মনসা, জিঞ্জির, সন্ধ্যা, প্রলয়-শিখা, দোলনচাঁপা, ছায়ানট, সিন্ধু হিল্লোল, চক্রবাক।

উপন্যাস           : বাঁধনহারা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা।

গল্প                : ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলিমালা, পদ্মগোখরা, জিনের বাদশা।

নাটক              : ঝিলমিলি, আলেয়া, পুতুলের বিয়ে।

প্রবন্ধগ্রন্থ          : যুগবাণী, দুর্দিনের যাত্রী, রাজবন্দীর জবানবন্দী, ধূমকেতু।

অনুবাদ            : রুবাইয়াত-ই- হাফিজ, রুবাইয়াত-ই- ওমর খৈয়াম

জীবনীগ্রন্থ         : মরুভাস্কর (হযরত মুহম্মদ (স.) এর জীবনীগ্রন্থ।

গানের সংকলন    : বুলবুল, চোখের চাতক, চন্দ্রবিন্দু,নজুরল গীতি, সুরলিপি, গানের মালা, চিত্তনামা।

বঙ্গবাণী কবিতার ব্যাখ্য ও বিশ্লেষণ এখানে

পুরুস্কার ও সম্মাননা 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাগত্তরিণী স্বর্ণপদক, ভারত সরকার প্রদত্ত ‘পদ্মভূষণ উপাধি লাভ। রবীন্দ্র ভারতী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ডি লিট ডিগ্রি প্রদান করে। তাছাড়া ১৯৭৬ সালে খ্রি. বাংলাদেশে সরকার ‘একুশে পদকএবং জাতীয় কবির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন।

মানুষ কবিতার মূলভাব

মানুষ কবিতায় মানুষের পবিত্রতা ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষিত হয়েছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি ও সামাজিক আচার-বিচারের মধ্যে যুগে যুগে মুনষ্যত্ব লাঞ্ছিত হয়েছে। ধর্ম-শাস্ত্র এবং মসজিদ মন্দিরের সীমানায় মানুষের মর্যাদা কোনোকালেই স্বীকৃতি লাভ করেনি। তাই কবি বলেছেন..

তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি।
মোল্লা পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!’

এ কবিতায় কবি সাম্যের গান গাইতে গিয়ে কবি ঘোষণা করেছেন যে, মানুষের চেয়ে বড় বা মহীয়ান কিছু নেই, মানুষের মধ্যে দেশ কাল পাত্রের ভেদ অস্বীকার করে এক অভেদ ধর্ম-জাতির কল্পনা করা হয়েছে। এ কবিতায় স্রষ্টাকে অস্বীকার করার কোন চেষ্টা তো নেই-ই বরং তার প্রতি কবি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুধার অন্ন তা বলে বন্ধ করনি প্রভু।

কবিতায় কবি ভজনালয়ে তালা দেওয়া যত দ্বার ভেঙে ফেলার আহ্বান জানালেও তিনি ভজনালয়কে ধ্বংস করতে চান নি, সব ভজনালয়ের দ্বার খুলে দিতে চেয়েছেন,

কোথা চেঙ্গিস, গজনি মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া দ্বার!

প্রকৃত অর্থে এ কবিতার উদ্দেশ্য ধর্মের আনুষ্ঠানিকতার, আচার সর্বস্বতার ভণ্ডামির মুখোশ উন্মোচন, ধর্মকে নাকচ করা নয়। নজরুলের প্রকৃত অভিযোগ, ‘তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!’ 


মানুষ কবিতায় বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা: 


           
     গাহি সাম্যের গান-

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!

ব্যাখ্যা: কবি এই চরণে সমতার কথার মধ্য দিয়ে মানুষের মহত্ত্বকে তুলে ধরেছেন। একতাবদ্ধ মানুষের চেয়ে সেরা জীব আর দ্বিতীয়টি নেই। সাম্যের বন্ধনে আবদ্ধ মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব।

 নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।-

ব্যাখ্যা: দেশকাল ধর্ম বর্ণ জাতি গোত্র এসব কিছুই মানুষের তুলনায় একেবারেই ক্ষুদ্র। জ্ঞাতি শব্দের অর্থ একই জাত বা সমগোত্রীয়। ধর্ম এবং ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণাগুলো মানুষের মাধ্যমেই প্রচলিত হয়েছে। এ সকল মনোভাবকে কবি মানুষের সমগোত্র থেকে জাত বলে মনে করেন।

                  পূজারী, দুয়ার খোলো,
ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হলো!’
স্বপন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়,
দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হ’য়ে যাবে নিশ্চয়!-

ব্যাখ্যা: পূজারী স্বপ্নে দেখল তাক কে যেন বলছে তার দুয়ারে ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়িয়ে আছেন, সে যেন দ্রুত সেই দুয়ার খুলে তাঁকে অভ্যর্থনা জানায়, তাঁর পূজা করে। তাই দেখে পূজারী ভজনালয় খুলতে গেল এবং ভাবতে লাগল দেবতার আশীর্বাদে আজ নিশ্চয় রাজা হয়ে যাবেন তিনি।

জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কন্ঠ ক্ষীণ
ডাকিল পান্থ, ‘দ্বার খোলো বাবা, খাইনিকো সাত দিন!’
সহসা বন্ধ হলো মন্দির, ভুখারী ফিরিয়া চলে,
তিমির রাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে!

ব্যাখ্যা: ছেঁড়া ময়লা জামা পরা একজন ক্ষুধার্ত ভিক্ষুক সেই ভজনালয়ের সামনে গিয়ে কাতর স্বরে বলল, বাবা দয়া করে দরজা খুলুন আমি সাত দিন ধরে উপোস, আমাকে কিছু খেতে দিন। তখন হঠাৎ সেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল এবং ক্ষুধার্ত ভিখারি ফিরে চলল অন্ধকার রাতে। সে পথ চলে আর অন্যদিকে ক্ষুধায় তার পেট জ্বলতে থাকে।

                  ভুখারি ফুকারি কয়,
ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!’

ব্যাখ্যা: ভিখারি চিৎকার করে বলে। জীর্ণ শীর্ণ অভুক্ত ভিখারি ক্ষুধা নিবারণের আশায় মন্দিরের দরজায় করা নাড়ে। কিন্তু দেবতার পূজারী মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেয়। দুঃখভারাক্রান্ত মনে ভিখারি তখন এই উক্তির আলোকপাত করে। ভিখারির মনের করুণ আর্তনাদ- মন্দিরে দেবতার আশীর্বাদ নেই, মানুষের ক্রুদ্ধতা সে জায়গা দখল করে নিয়েছে।

রানার কবিতার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ এই লিঙ্কে

মসজিদে কাল শিরনি আছিল, অঢেল গোস্ত-রুটি
বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটিকুটি!
এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে আজারির চিন,
বলে ‘বাবা, আমি ভুকা-ফাঁকা আছি আজ নিয়ে সাত দিন!’

ব্যাখ্যা: মসজিদে গতকাল শিরনি ছিল এবং সেখানে অনেক গোস্ত, রুটি বেঁচে গেছে। তা দেখে মোল্লা সাহেব খুবই খুশি।কবি এই চরণে একজন ক্লান্ত ব্যথিত মুসাফিরের আগমনের কথা তুলে ধরেছেন।বাবা, আমি খুব ক্ষুধার্ত। আজ নিয়ে ৭ দিন হয় কিছু খাইনি। আমাকে কিছু খেতে দিন।

 তেরিয়া হইয়া হাঁকিল মোল্লা – ‘ভ্যালা হলো দেখি লেঠা,
ভুখা আছো মরো গো-ভাগাড়ে গিয়ে! নামাজ পড়িস বেটা?’
ভুখারী কহিল, ‘না বাবা!’ মোল্লা হাঁকিল – ‘তা হলে শালা,
সোজা পথ দেখ!’ গোস্ত-রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা!

ব্যাখ্যা: ভুখা বলতে কবি এখানে অভুক্ত ও ক্লান্ত মুসাফিরের কথা বলেছেন। মিলাদ মাহফিলে বেঁচে যাওয়া রুটি মাংস আত্মসাৎ করার লোভে মোল্লা সাহবের মুখে ক্রূর হাসি ফুটে ওঠে। অথচ অভুক্ত মুসাফির সামান্য একটু খাবারের প্রত্যাশায় মসজিদের প্রাঙ্গণে গেলে মোল্লা সাহেব তাকে নামাজ না পড়ার অজুহাতে নির্মম ভাবে তিরস্কার করে। মুসাফিরকে তাচ্ছিল্য করে মৃত গরু ফেলার স্থানে গিয়ে মরতে বলা হয়। মসজিদের দুয়ার থেকে অভুক্ত মুসাফির ব্যথিত হৃদয় নিয়ে ফিরে যায়।

                  ভুখারি ফিরিয়া চলে,
                  চলিতে চলিতে বলে-
‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুধার অন্ন তা’বলে বন্ধ করনি প্রভু!
তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!’

ব্যাখ্যা: কবি এই চরণে মুসাফিরের মনের কথার মাধ্যমে ঈশ্বর , আল্লাহ, খোদার মহানুভবতা ও পরম ক্ষমাশীলতার দিকটি তুলে ধরেছেন। মানুষের অন্যায় কে খোদা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন। মুসাফির জীবনের অধিকাংশ সময়ে খোদাকে না ডেকে কাটিয়েছে, কিন্তু পরম করুণাময় কখনোই তার রিযিক বন্ধ করে দেন নি।ঈশ্বর কিংবা খোদার দুয়ারে সকল প্রাণীর রয়েছে সমান অধিকার।কিন্তু স্বার্থান্বেষী মানুষের লোভের কারণে সেই অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। তাদের ইচ্ছামত মসজিদ কিংবা মন্দিরের দুয়ার খুলছে বা বন্ধ হচ্ছে। মোল্লা আর পুরোহিতের মত লোভী মানুষদের হাতে উপাসনালয়ের চাবি থাকে। তাদের লোভের মুখে সাধারন মানুষদের ইচ্ছে পূরণ আর হয়ে উঠে না

কোথা চেঙ্গিস, গজনি-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার!

ব্যাখ্যা: স্রষ্টার ঘর মসজিদ, মন্দিরের সব দরজা খুলে দিতে বলেছেন কবি। তিনি বীর সাহসীদের সর্বশক্তি নিয়ে এগিয়ে যেতে বলেছেন। এ প্রসঙ্গে অনুপ্রেরণা হিসেবে সতের বার ভারতবর্ষ আক্রমণকারী গজনীর সুলতান মাহমুদ, বীর চেঙ্গিস খানকে তিনি স্মরণ করেছেন। যারা পবিত্র উপাসনালয়ের দরজা বন্ধ করে তাদের ধ্বংসের জন্য কবি দেবালয় ধ্বংসের হোতা কালাপাহাড়কে স্মরণ করেছেন।

খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি-শাবল চালা!

ব্যাখ্যা: ঈশ্বর কিংবা খোদার দুয়ারে তালা ঝুলানোর অধিকার কারো নেই। খোদার দুয়ারে মনের ইচ্ছা প্রকাশের অধিকার সবারই রয়েছে। কবি তপ্ত কণ্ঠে ঈশ্বর কিংবা খোদার দুয়ারে কপাট লাগানোর ঘোর বিরোধিতা করছেন। তিনি হাতুড়ি আর শাবল দিয়ে উপাসনালয়ের বন্ধ জানালাগুলোকে ভেঙ্গে ফেলার আহ্বান জানিয়েছেন।

                  হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়!

ব্যাখ্যা: উপাসনালয়ে বসে কিছু স্বার্থান্বেষী লোভী মানুষ মানবতাবাদের সাথে প্রতারণা করছে। তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে সাধারন মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ণ করছে তারা। কবি হতাশা ভরা কণ্ঠে উক্ত চরণগুলোতে তাদেরই আলোকপাত করেছেন।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন